জিহাদ
[এটি মাওলানা
মওদূদীর একটি
ভাষণ। ১৯৩৯
সালের ১৩ই
এপ্রিল ‘ইকবাল
দিবস’ উপলক্ষে
লাহোর টাউন
হলে মাওলানা
এ ভাষণ
প্রদান করেন।]
সাধারণত ইংরেজি ভাষায় জিহাদ শব্দটির
অনুবাদ holy war (পবিত্র যুদ্ধ)
করে মারাত্মক
বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়। দীর্ঘকাল
যাবত এই
শব্দটির যেরূপ
ব্যাখ্যা ও
বিশ্লেষণ করা
হচ্ছে, তার
ফলে ইহা
এখন ‘উন্মাদনা’
বা ‘পাগলামীর’
প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। এই শব্দটি
শ্রুত হওয়ার
সংগে সংগেই
শ্রোতার কল্পনা
দৃষ্টিতে এমন
এক ভয়ংকর
ও বিভীষিকাময়
দৃশ্য ভেসে
উঠে যে,
ধর্মপাগলের একটি দল যেন নগ্ন
তরবারি হস্তে,
শ্মশ্রু উত্তোলন
করে রক্ত
পিপাসু চোখে
‘আল্লাহ আকবার’
ধ্বনি করতে
করতে অগ্রসর
হচ্ছে আর
কাফেরদের পাওয়া
মাত্র গ্রেফতার
করছে এবং
তাদের গর্দানে
তরবারি রেখে
বলছেঃ ‘কালেমা
পড়’ নতুবা
এক্ষুণি গর্দান
দ্বিখণ্ডিত করা হবে। শঠ লেখকগণ
বিশেষ চাতুর্যের
সাথে আমাদের
এরূপ চিত্র
অংকিত করছে
এবং তার
সাথে এ
মন্তব্যটি জুড়ে দিয়েছে “রক্তের গন্ধ
আসে এ
জাতির ইতিহাস
হতে।”
মজার ব্যাপার
এই যে,
আমাদের এই
চিত্র যারা
অংকিত করেছে,
তারা নিজেরাই
বিগত কয়েক
শতাব্দীকাল যাবৎ মারাত্মক
অপবিত্র যুদ্ধে
(unholy war) লিপ্ত রয়েছে। তাদের
চরিত্র অত্যন্ত
বীভৎস। তারা সম্পদ ও শক্তির
লোভে সকল
প্রকার অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত
হয়ে নিতান্ত
দস্যুর ন্যায়
সমগ্র পৃথিবীতে
ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
তারা সর্বত্র
ব্যবসায়ের বাজার, কাঁচামালের সম্ভার, উপনিবেশ
স্থাপনের উপযোগী
অঞ্চল এবং
মূল্যবান দ্রব্যের
খনির সন্ধানে
ব্যতিব্যস্ত রয়েছে। লালসার আগুনের ইন্ধন
সংগ্রহ করে
এটাকে চির
প্রজ্বলিত করে রাখাই হলো তাদের
লক্ষ্য। লালসা
ও লোভের
পংকিল পথেই
তাদের সকল
চেষ্টা নিয়োজিত।
তাদের দৃষ্টিতে
কোনো দেশে
বিপুল খনিজ
সম্পদ বর্তমান
থাকা কিংবা
প্রচুর কাঁচামাল
উৎপন্ন হওয়াই তার
উপর প্রচন্ড
বিক্রমের সাথে
তাদের আক্রমণ
করার পক্ষে
যথেষ্ট কারণ।
এমন কি,
তাদের নিজ
দেশে উৎপন্ন
ব্যবসায় পণ্য
বিক্রয়ের উপযুক্ত
বাজার সৃষ্টির
সম্ভাবনা কোথাও
পরিলক্ষিত হলে অথবা তাদের অতিরিক্ত
জনসংখ্যা সে
দেশে প্রেরণ
করা সম্ভব
হলে সে
দেশের উপর
অনায়াসেই তারা
আক্রমণ চালাতে
পারে। আর
কিছু না
হলেও তাদের
অধিকৃত কিংবা
অধিকার করতে
ইচ্ছুক এমন
কোনো দেশে
যাওয়ার পথে
অপর কোনো
দেশের অবস্থানও
উহার আক্রান্ত
হওয়ার পক্ষে
যথেষ্ট কারণ।
বলা বাহুল্য,
আমরা যা
কিছু করেছি
তা অতীতের
ইতিহাস ; কিন্তু
তাদের এ
র্কীতিকলাপ তো অত্যাধুনিক। সাম্প্রতিক কালের
প্রত্যেকটি দিন ও রাত্রই বিশ্ববাসীর
চোখের সম্মুখেই
তাদের কার্যকলাপ
সংঘটিত হচ্ছে।
এশিয়া, আফ্রিকা,
ইউরোপ, আমেরিকা,
ভূ-মণ্ডলের
কোনো একটি
অংশও এই
লালসা পঙ্কিল
যুদ্ধ লিপ্সু জাতির
অপবিত্র আক্রমণের
আঘাত হতে
রক্ষা পাচ্ছে
না। তথাপি
তাদের চতুরতা
বড়ই প্রশংসনীয়।
কারণ তারা
আমাদের চিত্র
এতোখানি ভয়ানক
ও বিভীষিকাপূর্ণ
করে তুলে
ধরেছে যে,
তাদের নিজস্ব
কদর্য চিত্র
উহার অন্তরালে
লুকিয়ে গিয়েছে।
পক্ষান্তরে আমাদের সরলতাও কম প্রশংসার
যোগ্য নয়।
শত্রুপক্ষ কর্তৃক অংকিত আমাদের চিত্র
দেখে আমরা
এতোদূর ভীত
ও সন্ত্রস্ত
হয়ে পড়েছি
যে, উহার
পশ্চাতে একবার
দৃষ্টি নিক্ষেপ
করে স্বয়ং
চিত্র নির্মাতাদের
চেহারাটি দেখার
কথা পর্যন্ত
একদম ভুলে
বসেছি। উপরন্তু
আমরা কাতর
কণ্ঠে ও
অনুতাপের সুরে
বলতে শুরু
করেছিঃ “হুযুর
যুদ্ধ ও
প্রাণ-নাশের
সাথে আমাদের
কোনো সম্পর্কই
নেই। আমরা
তো বৌদ্ধ
ভিক্ষু ও
পাদ্রির ন্যায়
শান্তিপ্রিয় ধর্ম প্রচারক মাত্র। নির্দিষ্ট
কয়েকটি বিশ্বাসের
প্রতিবাদ এবং
তদস্থলে অপর
কয়েকটি আকীদা-বিশ্বাসের প্রচার
ও লোকদের
তা মেনে
নিতে বলাই
আমাদের কাজ।
তরবারির সংগে
তো আমাদের
কোনো সম্পর্ক
নেই। অবশ্য
আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার অপরাধ
কখনো কখনো
হয়ত আমরা
করে ফেলেছি।
কিন্তু বর্তমানে
তা হতেও
তওবা করেছি
; এমনকি, হুযুরের
অস্বস্তির জন্য ‘তরবারির যুদ্ধকে’ সরকারিভাবে
বাতিল করেও
দেয়া হয়েছে।
এখন শুধু
মুখ ও
লেখনির মারফতে
ধর্ম প্রচারেরই
নাম হচ্ছে
জিহাদ ; কামান,
বন্দুক ও
গোলা-বারুদ
ব্যবহার করা
সরকারের কাজ,
মুখ ও
লেখনি প্রয়োগই
হচ্ছে আমাদের
একমাত্র উপায়।”
জিহাদ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার কারণ
শুধু রাজনৈতিক
কূটকৌশলের পরিণামেই এ অবস্থার সৃষ্টি
হয়েছে। কিন্তু
যেসব কারণে
আল্লাহর পথে
জিহাদ এর
নিগূঢ় তত্ত্ব
দুরূহ হয়ে
পড়েছে, বৈজ্ঞানিক
পন্থায় তা
যাচাই করলে
তাতে দুইটি
প্রধান ও
মৌলিক ভুল
ধারণার সন্ধান
পাওয়া যায়।
প্রথম ভুল
ধারণা এই
যে, ইসলামকে
অন্যান্য ধর্মের
ন্যায় সাধারণত
যে অর্থে
এ শব্দ
ব্যবহৃত হয়
তদনুযায়ী নিছক
একটি ধর্ম
বলে মনে
করা হয়েছে।
আর দ্বিতীয়
ভুল ধারণা
এই যে,
মুসলমানদেরকে অন্যান্য জাতির ন্যায় সাধারণত
যে অর্থে
এ শব্দ
ব্যবহৃত হয়
তদনুযায়ী একটি
জাতিই মাত্র
মনে করা
হয়েছে।
এই দুইটি
ভ্রান্তধারণা কেবল জিহাদের ব্যাপারটি নয়
সামগ্রিকভাবে গোটা ইসলামের রূপকেই পরিবর্তিত
ও বিকৃত
করে দিয়েছে।
এবং মুসলমানদের
স্থান ও
মর্যাদা সম্পূর্ণভাবে
নষ্ট করে
ফেলেছে।
সাধারণ পরিভাষা অনুযায়ী ধর্ম বলতে
কতকগুলি আকিদা-বিশ্বাস ও
কয়েকটি ইবাদত-অনুষ্ঠানের সমষ্টি
ছাড়া আর
কিছুই বুঝা
যায় না।
এ অর্থের
দিক দিয়ে
ধর্ম একটি
ব্যক্তিগত ব্যাপার, তা নিঃসন্দেহ। এমতাবস্থায়
যে কোনো
আকিদা মনে
স্থান দেয়া,
মন যার
ইবাদত করতে
ইচ্ছুক তারই
ইবাদত করা
যেভাবে ইচ্ছা
তাকে ডেকে
প্রভৃতি কাজের
পূর্ণ স্বাধীনতা
প্রত্যেক ব্যক্তিই
লাভ করতে
পারে। সংশ্লিষ্ট
ধর্মের জন্য
খুব বেশি
দরদ ও
প্রেমবোধ করলে পৃথিবী ব্যাপী নিজ
আকিদার প্রচার
করা এবং
অন্যান্য আকিদাপন্থীদের
সাথে ‘বিতর্ক
ও বাহাস’
করার স্বাধীনতাও
তার রয়েছে।
এতোটুকু কাজের
জন্য তরবারি
ধারণ করার
কি প্রয়োজন
থাকতে পারে?
লোকদের মারধোর
করে তো
কোনো আকিদার
প্রতি বিশ্বাস
জন্মানো যায়
না। বস্তুত
ইসলামকে সাধারণ
পরিভাষা অনুযায়ী
একটি ‘ধর্ম’
হিসেবে মেনে
নিলে এবং
মূলত ইসলাম
তা হলে
প্রকৃতপক্ষে জিহাদের সমর্থনে কোনো সংগত
যুক্তিই পেশ
করা যেতে
পারে না।
অনুরূপভাবে ‘জাতি’ বলতে সমপ্রকৃতি বিশিষ্ট
কতগুলো লোকদের
এমন একটি
সমষ্টি (a homogeneous group of men) বুঝায়, যারা
কয়েকটি মৌলিক
ব্যাপারে অংশীদার
হওয়ার কারণে
একত্রিত এবং
অন্যান্য সমষ্টি
হতে স্বতন্ত্র
মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত
হয়েছে। এই
অর্থের দিক
দিয়ে যে
মানব সমষ্টি
একটি জাতির
মর্যাদা পাবে
মাত্র দু’টি কারণেই
তাদের পক্ষে
তরবারি ধারণ
করা সংগত
হতে পারে।
একঃ তাদের
ন্যায়সংগত অধিকার হরণ করার জন্য
কেউ তাদের
উপর আক্রমন
করলে। দুইঃ
তারা নিজেরাই
অপরের ন্যায়সংগত
অধিকার কেড়ে
নেবার জন্য
আক্রমণ করতে
চাইলে। প্রথম
অবস্থায় তরবারি
ধারণের কিছু
না কিছু
নৈতিক বৈধতা
রয়েছে (যদিও
কোনো কোনো
ধর্মাত্মার দৃষ্টিতে এটাও পাপ), কিন্তু
দ্বিতীয় অবস্থাটিকে
চরম ডিকটেটর
ছাড়া অপর
কেউ বৈধ
বলে দাবি
করতে পারে
না। এমনকি
ফ্রান্স ও
বৃটেনের ন্যায়
বিশাল সাম্রাজ্যের
কূটনীতিকরাও এটাকে সংগত বলার দুঃসাহস
করবে না।
জিহাদের তত্ত্ব কথা

অন্যান্য বিপ্লবী মতাদর্শের ন্যায় ইসলামও
সাধারণভাবে প্রচলিত শব্দ পরিত্যাগ করে
নিজস্ব একটি
পরিভাষা (terminology) ব্যবহার করেছে।
ফলে তার
বিপ্লবী ধারণা
প্রচলিত সাধারণ
ধারণা হতে
বিশিষ্টতা লাভ করেছে। ‘জিহাদ’ শব্দটি
এ বিশেষ
পরিভাষার অন্যতম।
‘হারব’ (যুদ্ধ)
বা এ
অর্থবোধক অন্য কোনো আরবি শব্দই
ইসলাম স্বতপ্রবৃত্ত
হয়েই প্রয়োগ
করেনাই, এর
পরিবর্তে ব্যবহার
করেছে ‘জিহাদ’। ইহা
struggle (সংগ্রাম) এর সমার্থবোধক,
বরং এটার
আধিক্যের অর্থ
জ্ঞাপক। ইংরেজিতে
এটার মর্মার্থ
হতে পারে
to exert one’s utmost endeavour in promoting a cause অর্থাৎ কোনো
নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য লাভের জন্য সমগ্র
শক্তি নিয়োগ
করা।
কিন্তু পুরাতন ও সাধারণ প্রচলিত
শব্দ ত্যাগ
করে এ
নতুন শব্দ
কেন ব্যবহার
করা হলো?
এর একমাত্র
উত্তর এই
যে, ব্যক্তি
কিংবা দলসমূহের
পংকিল স্বার্থ
উদ্ধার করার
উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি ও
সাম্রাজ্যগুলো যেসব যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ড
করেছে, ‘যুদ্ধ’
শব্দটি তা
বুঝার জন্য
চিরদিন ব্যবহৃত
হয়েছে এবং
এখনও হচ্ছে।
এসব যুদ্ধের
লক্ষ্য হয়
ব্যক্তিগত কিংবা সমষ্টিগত উদ্দেশ্য সিদ্ধি।
তাতে কোনো
মতাদর্শ অথবা
কোনো নিয়ম-নীতির সমর্থন
ও প্রতিষ্ঠার
উদ্দেশ্য মোটেই
থাকে না।
কিন্তু ইসলামের
যুদ্ধ এধরনের
নয় বলে
গোড়াতেই এ
শব্দটি ব্যবহার
করেনাই। বিশেষ
কোনো জাতির
লাভ বা
ক্ষতি সাধন
এর লক্ষ্য
নয়। দেশের
উপর কোন্
শাসকের শাসন
চলবে সে
বিষয়েও এর
ভ্রুক্ষেপ নেই। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য
হচ্ছে শুধু
মানবতার কল্যাণ
সাধন। এ
কল্যাণের জন্য
ইসলাম একটি
বিশেষ আদর্শ
এবং বাস্তব
কর্মসূচী পেশ
করেছে। এ
নীতি ও
মতাদর্শের বিপরীত যেখানেই যে হুকুম
প্রতিষ্ঠিত রয়েছে ইসলাম সেটাকে নির্মূল
করতে চায়
তা যে
জাতি বা
দেশেই হোক
না কেন।
ইসলাম তার
নিজস্ব আদর্শ
ও কর্মসূচী
অনুযায়ী নতুন
সরকার প্রতিষ্ঠা
করতে চায়
কে তার
পতাকা বহন
করছে, আর
কার শাসন
কতৃêত্বের
উপর উহার
চরম আঘাত
পড়ে, সেদিক
দিয়ে কোনো
পার্থক্যই করা হয়না। ইসলাম চায়
পৃথিবী, পৃথিবীর
কোনো অংশ
নয়। সমগ্র
ভূ-মন্ডলই
ইহার লক্ষ্য।
কিন্তু বিশেষ
কোনো জাতি
বা বহু
জাতির হাত
হতে ক্ষমতা
কেড়ে নেয়া
অন্য কোনো
বিশেষ জাতির
হাতে তুলে
দেয়া ইসলামের
লক্ষ্য নয়।
এর একমাত্র
লক্ষ্য এই
যে, গোটা
মানবতার কল্যাণ
সাধনের জন্য
তার যে
মতাদর্শ ও
কর্মসূচী রয়েছে
যার নাম
হচ্ছে ইসলাম
সমগ্র বিশ্বমানবকে
তার দ্বারা
পরিতৃপ্ত ও
ঐশ্বর্যমন্ডিত করে তুলতে হবে। এ
মহান উদ্দেশ্যে
বিপ্লব সৃষ্টির
অনুকূলে ইহা
সমগ্র কার্যকর
শক্তিকেই প্রয়োগ
করতে চায়।
এভাবে সমস্ত
শক্তি প্রয়োগের
সমষ্টিগত নামই
হচ্ছে ‘জিহাদ’। মুখের
ভাষা ও
লেখনির সাহায্যে
মানুষের চিন্তাধারা
ও দৃষ্টিভংগিতে
পরিবর্তন করা
এবং তাদের
মধ্যে ‘অন্তর্বিপ্লব’
সৃষ্টি করাকেও
জিহাদ বলা
যায়। তরবারি
(শক্তি) ব্যবহার
করে প্রতিষ্ঠিত
জীবন ব্যবস্থা
নির্মূল করে
নবতর সুবিচারমূলক
সমাজ ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠা করাকেও জিহাদ বলা হয়।
এপথে ধন
মাল ব্যয়
করা, শারীরিক
শক্তি সামর্থ
নিয়োগ করাও
জিহাদ।
জিহাদ আল্লাহর পথে
মনে রাখতে
হবে যে,
ইসলামের জিহাদ
শুধুমাত্র ‘জিহাদই’ নয়, এই জিহাদ
হবে সম্পূর্ণরূপে
আল্লাহর পথে।
‘আল্লাহর পথে’
কথাটি ইহার
অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ শব্দ দু’টি ইসলামের
বিশেষ পরিভাষার
সাথে সংশ্লিষ্ট।
অবশ্য ‘আল্লাহর
পথে’ কথা
দ্বারা অনেক
লোকের মনে
এক ভুল
ধারণার সৃষ্টি
হয়েছে। তারা
মনে করে
যে, মানুষকে
জোরপূর্বক ইসলামের আকিদা-বিশ্বাসের অনুসারী
করে তোলাই
বুঝি আল্লাহর
পথে জিহাদ।
সংকীর্ণমনা লোকেরা ‘আল্লাহর পথে’ কথাটির
এই বিকৃত
অর্থই গ্রহণ
করেছে, এতদ্ব্যতীত
অন্য কোনো
অর্থই তাদের
মনে স্থান
পায় নাই।
কিন্তু ইসলামী
পরিভাষায় এর
অর্থ অত্যন্ত
ব্যাপক। সামাজিক
কল্যাণ ও
মঙ্গল সাধনের
উদ্দেশ্যে যে কাজই করা হবে,
তার নিয়ত
যদি কোনো
বৈষয়িক স্বার্থ
ও সুযোগ-সুবিধা লাভ
করা না
হয়, বরং
আল্লাহর সন্তোষ
লাভই যদি
তার চূড়ান্ত
লক্ষ্য হয়,
তবে ইসলাম
এ সকল
কাজকে ‘আল্লাহর
পথে’ বলে
ঘোষণা করে।
উদাহরণ স্বরূপ
দান-খয়রাতের
কথা উল্লেখ
করা যেতে
পারে। কোনো
বৈষয়িক কিংবা
নৈতিক স্বার্থ
লাভের উদ্দেশ্যে
দান-খয়রাত
করলে তা
‘আল্লাহর পথে’
হবে না।
কিন্তু আল্লাহর
সন্তোষ লাভ
করার উদ্দেশ্যে
কোনো দরিদ্র
ব্যক্তিকে সাহায্য করা হলে ইহা
নিশ্চয়ই ‘আল্লাহর
পথে’ হবে।
অতএব পরিপূর্ণ
নিষ্ঠা ও
ঐকান্তিকতার সাথে সকল প্রকার স্বার্থবাদের
উর্ধ্বে থেকে
যে কোনো
কাজই করা
হবে এবং
এই ধারণার
বশবর্তী হয়ে
করা হবে
যে, মানুষের
কল্যাণের জন্য
কাজ করাই
হচ্ছে আল্লাহর
সন্তোষ লাভের
একমাত্র উপায়,
আর বিশ্ব-স্রষ্টার সন্তোষ
লাভ ভিন্ন
মানব জীবনের
আর কিছু
লক্ষ্যও হতে
পারে না-
ইহার প্রত্যেকটি
কাজকেই ‘আল্লাহর
পথে’ বলে
ঘোষণা করা
যাবে।
বস্তুত জিহাদের পূর্বেও ‘আল্লাহর পথে’
শর্তটি এ
জন্যই যুক্ত
করা হয়েছে।
এর অর্থ
এই যে,
কোনো ব্যক্তি
কিংবা দল
যখন রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় বিপ্লব
সাধন অথবা
ইসলামী মতাদর্শ
অনুযায়ী নব
বিধান প্রণয়ন
করতে অগ্রসর
হবে, তখন
তার এই
প্রচেষ্টায় ও আত্মদানে ব্যক্তিগত স্বার্থলাভ
তার লক্ষ্য
হতে পারবে
না। ‘কাইজার’কে বিতাড়িত
করে সে
নিজেই যেন
‘কাইজার’ সাজবার
ইচ্ছা পোষণ
না করে।
নিজের জন্য
ধন-মাল,
খ্যাতি-প্রসিদ্ধ,
মান-সম্মান,
কোনো কিছু
লাভ করাই
যেন তার
চেষ্টা- শ্রমের
মূল লক্ষ্য
না হয়।
তার সমস্ত
কুরবানী ও
শ্রম-সাধনার
প্রকৃত উদ্দেশ্য
হবে মানবসমাজে
এক সুবিচার
পূর্ণ জীবন
ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং এর বিনিময়ে
আল্লাহর সন্তোষ
লাভ করা।
এতদি্ভন্ন
তার কোনো
উদ্দেশ্যই থাকবে না। কুরআন শরীফে
বলা হয়েছেঃ
الَّذِينَ آمَنُواْ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُواْ
يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ
‘ঈমানদার লোকেরা আল্লাহর পথে লড়াই
করে, কাফেরগণ
লড়াই করে
তাগুতের পথে।’
(সূরা আন
নিসাঃ ৭৬)
‘তাগুত’ শব্দের মূল হচ্ছে ‘তুগইয়ান’
ইহার অর্থ
সীমা লংঘন
করা। নদীর
পানি উচ্ছ্বসিত
হয়ে যখন
ইহার সীমা
অতিক্রম করে,
তখন বলা
হয় নদীতে
‘তুগইয়ানী’ (প্লাবন) এসেছে। মানুষ যদি
নিজের সংগত
সীমা অতিক্রম
করে অন্য
মানুষের ‘খোদা’
(সার্বভৌম) হবার জন্য কিংবা অতিরিক্ত
স্বার্থ লাভের
উদ্দেশ্যে নিজের শক্তি ও ক্ষমতা
প্রয়োগ করে,
তবে এটাকেই
বলা হয়
‘তাগুতের পথে
সংগ্রাম’।
‘আল্লাহর পথে’
সংগ্রাম এটার
সম্পূর্ণ বিপরীত।
ইহার চরম
লক্ষ্য হবে
পৃথিবীতে আল্লাহর
সুবিচারমূলক আইন প্রতিষ্ঠিত করা। সংগ্রামী
ব্যক্তি নিজেও
ইহা পালন
করার জন্য
চেষ্টা করবে
এবং অন্যকেও
ইহা পালন
করানোর চেষ্টা
করবে। কুরআনে
বলা হয়েছেঃ
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا
فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ
‘পারলৌকিক সম্মান ও মর্যাদা তোমাদের
জন্য নির্দিষ্ট
করে রেখেছি,
যারা পৃথিবীতে
নিজের শ্রেষ্ঠত্ব
ও প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠা করতে এবং বিশৃংখলা সৃষ্টি
করতে চায়
না। বস্তুত
পারলৈাকিক সাফল্য এধরনের পরহেযগার লোকদের
জন্যই নির্ধারিত
রয়েছে।’ (সূরা
আল কাসাসঃ
৮৩)
হাদিসে উল্লেখিত হয়েছেঃ “এক ব্যক্তি
নবী করীম
(সা)-কে
জিজ্ঞাসা করলো,
‘আল্লাহর পথে
যুদ্ধের’ অর্থ
কি? এক
ব্যক্তি ধন
সম্পদের জন্য
যুদ্ধ করে
অপর ব্যক্তি
বীরত্বের খ্যাতি
লাভ করার
জন্য যুদ্ধ
করে, আর
তৃতীয় ব্যক্তি
শত্রুতা সাধনের
জন্য কিংবা
জাতির গৌরব
অহংকার রক্ষার
জন্য যুদ্ধ
করে। ইহাদের
মধ্যে কার
যুদ্ধ ‘আল্লাহর
পথে’ হচ্ছে?”
হযরত (সা)
উত্তরে বললেনঃ
“এদের কারো
যুদ্ধই ‘আল্লাহর
পথে’ নয়।
যে ব্যক্তি
কেবল ‘আল্লাহর
বিধান’ প্রতিষ্ঠার
উদ্দেশ্যেই যুদ্ধ করবে, শুধু তার
যুদ্ধই ‘আল্লাহর
পথে’ হবে।”
অন্য এক
হাদিসে বলা
হয়েছেঃ “যদি
কেহ যুদ্ধ
করে আর
উট বাঁধবার
একগাছ রশি
লাভ করাও
তার ‘নিয়ত’
হয় তবে
সে কোনো
ফল লাভ
করতে পারবেনা।
যে কাজ
কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য
হবে, আল্লাহ
শুধু তাই
কবুল করবেন।
অবশ্য যদি
তার কোনো
ব্যক্তিগত কিংবা সমষ্টিগত স্বার্থ লাভ
উদ্দেশ্য না
থাকে।”
অতএব ইসলামের
দৃষ্টিতে জিহাদের
সঙ্গে ‘আল্লাহর
পথে’ একটি
অপরিহার্য ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
নিছক যুদ্ধ
তো পৃথিবীর
প্রত্যেকটি জীবই করছে। প্রত্যেকেই নিজ
নিজ উদ্দেশ্য
লাভের জন্য
পূর্ণ শক্তি
প্রয়োগ করে
চেষ্টা করছে।
কিন্তু মুসলমান
একটি বিপ্লবী
দলের নাম
; জীবন ও
ধন-মাল
প্রয়োগ করে
দুনিয়ার সকল
আল্লাহদ্রোহি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা
এবং এতদুদ্দেশ্যে
দেহ ও
আত্মার সকল
শক্তি নিযুক্ত
করা ইসলামের
বিপ্লবী মতাদর্শের
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
অংশ। কিন্তু
তা প্রতিষ্ঠিত
আল্লাহদ্রোহিদের বিচূøত
করে নিজেই
তাদের স্থান
দখল করার
জন্য নয়।
বরং এজন্য
যে, পৃথিবীর
বুক হতে
আল্লাহদ্রোহিতার (সীমালংঘন) মূলোৎপাটন
করা এবং
সর্বত্র একমাত্র
আল্লাহর আইন
চালু করা
বিশ্বমানবতার নিরাপত্তার জন্য একান্ত অপরিহার্য।
অতপর আমি ইসলামের বিপ্লবী আহ্বানের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করতে চাই। এ আলোচনা দ্বারা জিহাদের অপরিহার্যতা এবং এর মূল লক্ষ্য (ড়নলবপঃরাব) সুস্পষ্ট রূপে বুঝা যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন