নামকরণ
কুরআন মজীদের এ শেষ সূরা দু’টি আলাদা আলাদা সূরা ঠিকই এবং মূল লিপিতে এ
সূরা দু’টি ভিন্ন ভিন্ন নামেই লিখিত হয়েছে, কিন্তু এদের পারস্পরিক সম্পর্ক
এত গভীর এবং উভয়ের বিষয়বস্তু পরস্পরের সাথে এত বেশী নিকট সম্পর্ক রাখে যার
ফলে এদের একটি যুক্ত নাম “মু’আওবিযাতাইন” (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার দু’টি
সূরা) রাখা হয়েছে। ইমাম বায়হাকী তাঁর “দালায়েলে নবুওয়াত” বইতে লিখেছেনঃ এ
সূরা দু’টি নাযিলও হয়েছে একই সাথে। তাই উভয়ের যুক্ত নাম রাখা হয়েছে
“মু’আওবিযাতাইন”। আমরা এখানে উভয়ের জন্য একটি সাধারণ ভূমিকা লিখছি। কারণ,
এদের উভয়ের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলী ও বক্তব্য সম্পূর্ণ একই পর্যায়ভুক্ত।
তবে ভূমিকায় একত্র করার পর সামনের দিকে প্রত্যেকের আলাদা ব্যাখ্যা করা হবে।
নাযিলের সময়-কাল
হযরত হাসান বসরী, ইকরামা, আতা ও জাবের ইবনে যায়েদ বলেন, এ সূরা দু’টি
মক্কী। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকেও এ ধরনের একটি উক্তি বর্ণিত
হয়েছে। কিন্তু তাঁর অন্য একটি বর্ণনায় একে মাদানী বলা হয়েছে। আর হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রাঃ) ও কাতাদাহও একই উক্তি করেছেন। যে সমস্ত হাদীস
এ দ্বিতীয় বক্তব্যটিকে শক্তিশালী করে তার মধ্যে মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ ও
মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বলে, হযরত উকবা ইবনে আমের (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীস
হচ্ছেঃ একদিন রসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বলেনঃ
আরবী---------------------------------
“তোমরা কি কোন খবর রাখো, আজ রাতে আমার ওপর কেমন ধরনের আয়াত নাযিল হয়েছে?
নজীরবিহীন আয়াত! কুল আউযু বি রব্বিল ফালাক এবং কুল আউযু বি রব্বিন নাস।”
হযরত উকবা ইবনে আমের (রাঃ) হিজরতের পরে মদীনা তাইয়েবায় ইসলাম গ্রহণ করেন
বলেই এ হাদীসের ভিত্তিতে এ সূরা দু’টিকে মাদানী বলার যৌক্তিকতা দেখা দেয়।
আবু দাউদ ও নাসাঈ তাদের বর্ণনায় একথাই বিবৃত করেছেন। অন্য যে রেওয়ায়াতগুলো এ
বক্তব্যকে শক্তিশালী করেছে সেগুলো ইবনে সা’দ, মুহিউস সুন্নাহ বাগাবী, ইমাম
নাসাঈ, ইমাম বায়হাকী, হাফেজ ইবনে হাজার, হাফেজ বদরুদ্দীন আইনী, আবদ ইবনে
হুমায়েদ এবং আরো অনেকে উদ্ধৃত করেছেন। সেগুলোতে বলা হয়েছেঃ ইহুদীরা যখন
মদীনায় রসূলুল্লাহ ﷺ এর ওপর যাদু করেছিল এবং তার প্রভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে
পড়েছিলেন তখন এ সূরা নাযিল হয়েছিল। ইবনে সা’দ ওয়াকেদীর বরাত দিয়ে বর্ণনা
করেছেন, এটি সপ্তম হিজরীর ঘটনা। এরই ভিত্তিতে সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাও এ সূরা
দু’টিকে মাদানী বলেছেন।
কিন্তু ইতিপূর্বে সূরা ইখলাসের ভূমিকায় আমরা বলেছি, কোন সূরা বা আয়াত
সম্পর্কে যখন বলা হয়, অমুক সময় সেটি নাযিল হয়েছিল। তখন এর অর্থ নিশ্চিতভাবে
এ হয় না যে, সেটি প্রথমবার ঐ সময় নাযিল হয়েছিল। বরং অনেক সময় এমনও হয়েছে,
একটি সূরা বা আয়াত প্রথমে নাযিল হয়েছিল, তারপর কোন বিশেষ ঘটনা বা অবস্থার
পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পুনর্বার তারই প্রতি বরং কখনো কখনো
বারবার তার প্রতি নবী ﷺ এর দৃষ্টি আকৃষ্ট করা হয়েছিল। আমাদের মতে সূরা নাস ও
সূরা ফালাকের ব্যাপারটিও এ রকমের। এদের বিষয়বস্তু পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে,
প্রথমে মক্কায় এমন এক সময় সূরা দু’টি নাযিল হয়েছিল যখন সেখানে নবী করীমের ﷺ
বিরোধিতা জোরেশোরে শুরু হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন মদীনা তাইয়েবায়
মুনাফিক, ইহুদী ও মুশরিকদের বিপুল বিরোধিতা শুরু হলো, তখন তাঁকে আবার ঐ
সূরা দু’টি পড়ার নির্দেশ দেয়া হলো। ওপরে উল্লেখিত হযরত উকবা ইবনে আমেরের
(রাঃ) রেওয়ায়াতে একথাই বলা হয়েছে। তারপর যখন তাঁকে যাদু করা হলো এবং তাঁর
মানসিক অসুস্থতা বেশ বেড়ে গেলো তখন আল্লাহর হুকুমে জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম
এসে আবার তাঁকে এ সূরা দু’টি পড়ার হুকুম দিলেন। তাই আমাদের মতে যেসব
মুফাস্সির এ সূরা দু’টিকে মক্কী গণ্য করেন তাদের বর্ণনাই বেশী
নির্ভরযোগ্য। সূরা ফালাকের শুধুমাত্র একটি আয়াত (আরবী---------ওয়া মিন
শার্রিন্ নাফ্ফাসাতি ফিল উ’কাদ) যাদুর সাথে সম্পর্ক রাখে, এছাড়া আল
ফালাকের বাকি সমস্ত আয়াত এবং সূরা নাসের সবক’টি আয়াত এ ব্যাপারে সরাসরি কোন
সম্পর্ক রাখে না। যাদুর ঘটনার সাথে এ সূরা দু’টিকে সম্পর্কিত করার পথে
এটিও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
মক্কা মু’আয্যমায় এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে এ সূরা দু’টি নাযিল হয়েছিল। তখন
ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই মনে হচ্ছিল, রসূলুল্লাহ্ ﷺ যেন ভীমরুলের
চাকে হাত দিয়ে ফেলেছেন। তাঁর দাওয়াত যতই বিস্তার লাভ করতে থেকেছে কুরাঈশ
বংশীয় কাফেরদের বিরোধিতাও ততোই বেড়ে যেতে থেকেছে। যতদিন তাদের আশা ছিল
কোনরকম দেয়া-নেয়া করে অথবা ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে তাঁকে ইসলামী দাওয়াতের কাজ থেকে
বিরত রাখতে পারা যাবে, ততদিন তো বিদ্বেষ ও শত্রুতার তীব্রতার কিছুটা কমতি
ছিল। কিন্তু নবী করীম ﷺ যখন দ্বীনের ব্যাপারে তাদের সাথে কোন প্রকার আপোষ
রফা করার প্রশ্নে তাদেরকে সম্পূর্ণ নিরাশ করে দিলেন এবং সূরা আল কাফেরূনে
তাদেরকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিলেন--- যাদের বন্দেগী তোমরা করছো আমি তার
বন্দেগী করবো না এবং আমি যাঁর বন্দেগী করছি তোমরা তাঁর বন্দেগী করো না,
কাজেই আমার পথ আলাদা এবং তোমাদের পথও আলাদা--- তখন কাফেরদের শত্রুতা চরমে
পৌঁছে গিয়েছিল। বিশেষ করে যেসব পরিবারের ব্যক্তিবর্গ (পুরুষ-নারী,
ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে) ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের মনে তো নবী করীমের ﷺ
বিরুদ্ধে সবসময় তুষের আগুন জ্বলছিল। ঘরে ঘরে তাঁকে অভিশাপ দেয়া হচ্ছিল। কোন
দিন রাতের আঁধারে লুকিয়ে তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। যাতে বনী
হাশেমদের কেউ হত্যাকারীর সন্ধান পেয়ে আবার প্রতিশোধ নিতে না পারে এজন্য এ
ধরনের পরামর্শ চলছিল। তাঁকে যাদু-টোনা করা হচ্ছিল। এভাবে তাঁকে মেরে ফেলার
বা কঠিন রোগে আক্রান্ত করার অথবা পাগল করে দেয়ার অভিপ্রায় ছিল। জিন ও
মানুষদের মধ্যকার শয়তান সবদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা চাচ্ছিল জন-মানুষের মনে
তাঁর এবং তিনি যে দ্বীন তথা জীবন বিধান কুরআন এনেছেন তার বিরুদ্ধে কোন না
কোন সংশয় সৃষ্টি করতে। এর ফলে লোকেরা তাঁর প্রতি বিরূপ ধারণা করে দূরে সরে
যাবে বলে তারা মনে করছিল। অনেক লোকের মনে হিংসার আগুন জ্বলছিল। কারণ তারা
নিজেদের ছাড়া বা নিজেদের গোত্রের লোকদের ছাড়া আর কারো প্রদীপের আলো জ্বলতে
দেখতে পারতো না। উদাহরণ স্বরূপ, আবু জেহেল যে কারণে রসূলুল্লাহ ﷺ এর
বিরোধিতায় সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল সেটি ছিল তার নিজের ভাষায়ঃ “আমাদের ও বনী
আবদে মান্নাফের (তথা রসূলুল্লাহ ﷺ এর পরিবার) মধ্যে ছিল পারস্পরিক
প্রতিযোগিতা। তারা মানুষকে আহার করিয়েছে, আমরাও আহার করিয়েছি। তারা
লোকদেরকে সওয়ারী দিয়েছে, আমরাও দিয়েছি। তারা দান করেছে, আমরাও দান করেছি।
এমন কি তারা ও আমরা মান মর্যাদার দৌঁড়ে সমানে সমান হয়ে গেছি। এখন তারা বলছে
কি, আমাদের মধ্যে একজন নবী আছে, তার কাছে আকাশ থেকে অহী আসে। আচ্ছা, এখন
এক্ষেত্রে আমরা তাদের সাথে কেমন করে মোকাবেলা করতে পারি? আল্লাহর কসম, আমরা
কখনো তাঁকে মেনে নেবো না এবং তাঁর সত্যতার স্বীকৃতি দেবো না।” (ইবনে
হিশাম, প্রথম খণ্ড, ৩৩৭-৩৩৮ পৃষ্ঠা)
এহেন অবস্থায় রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে বলা হয়েছেঃ এদেরকে বলে দাও আমি আশ্রয়
চাচ্ছি সকাল বেলার রবের, সমুদয় সৃষ্টির দুষ্কৃতি ও অনিষ্ট থেকে, রাতের
আঁধার থেকে, যাদুকর ও যাদুকারিণীদের অনিষ্ট থেকে এবং হিংসুকদের দূষ্কৃতি
থেকে। আর এদেরকে বলে দাও, আমি আশ্রয় চাচ্ছি সমস্ত মানুষের রব, সমস্ত
মানুষের বাদশা ও সমস্ত মানুষের মা’বুদের কাছে। এমন প্রত্যেকটি সন্দেহ ও
প্ররোচনা সৃষ্টিকারীর অনিষ্ট থেকে যা বারবার ঘুরে ফিরে আসে এবং মানুষের মনে
সন্দেহ সৃষ্টি করে ও তাদেরকে প্ররোচিত করে। তারা জিন শয়তানদের মধ্য থেকে
হতে পারে, আবার মানুষ শয়তানদের মধ্য থেকেও হতে পারে। এটা হযরত মূসার (আঃ)
ঠিক সেই সময়ের কথার মতো যখন ফেরাউন ভরা দরবারে তাঁকে হত্যা করার সংকল্প
প্রকাশ করেছিল। হযরত মূসা তখন বলেছিলেনঃ
আরবী------------------
“আমি নিজের ও তোমাদের রবের আশ্রয় নিয়েছি এমন ধরনের প্রত্যেক দাম্ভিকের
মোকাবেলায় যে হিসেবের দিনের প্রতি ঈমান রাখে না।” (আল মু’মিন, ২৭)
আরবী-------------------------------
“আর তোমরা আমার ওপর আক্রমণ করবে এজন্য আমি নিজের ও তোমাদের রবের আশ্রয় নিয়েছি।” (আদ দুখান, ২০)।
উভয় স্থানেই আল্লাহ্র এ মহান মর্যাদাসম্পন্ন পয়গম্বরদের নিতান্ত
সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় বিপুল উপায়-উপকরণ ও ক্ষমতা-প্রতিপত্তির অধিকারীদের
সাথে মোকাবেলা করতে হয়েছিল। উভয় স্থানেই শক্তিশালী দুশমনদের সামনে তাঁরা
নিজেদের সত্যের দাওয়াত নিয়ে অবিচল দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। অথচ
দুশমনদের মোকাবেলা করার মতো কোন বস্তুগত শক্তি তাদের ছিল না। উভয় স্থানেই
তাঁরা “তোমাদের মোকাবেলায় আমরা বিশ্ব-জাহানের রবের আশ্রয় নিয়েছি” এই বলে
দুশমনদের হুমকি-ধামকি মারাত্মক বিপজ্জনক কূট-কৌশল ও শত্রুতামূলক চক্রান্ত
উপেক্ষা করে গেছেন। মূলতঃ যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে, আল্লাহর শক্তি সব শক্তির
সেরা, তাঁর মোকাবেলায় দুনিয়ার সব শক্তি তুচ্ছ এবং যে ব্যক্তি তাঁর আশ্রয়
নিয়েছে তার সামান্যতম ক্ষতি করার ক্ষমতাও কারো নেই। একমাত্র সেই ব্যক্তিই এ
ধরনের অবিচলতা, দৃঢ় সংকল্প ও উন্নত মনোবলের পরিচয় দিতে পারে এবং সে-ই একথা
বলতে পারেঃ সত্যের বাণী ঘোষণার পথ থেকে আমি কখনই বিচ্যূত হবো না। তোমাদের
যা ইচ্ছা করে যাও। আমি তার কোন পরোয়া করি না। কারণ আমি তোমাদের ও আমার
নিজের এবং সারা বিশ্ব-জাহানের রবের আশ্রয় নিয়েছি।
এ সূরা দু’টি কুরআনের অংশ কিনা
এ সূরা দু’টির বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য অনুধাবন করার জন্য ওপরের
আলোচনাটুকুই যথেষ্ট। তবুও হাদীস ও তাফসীর গ্রন্থগুলোয় এদের সম্পর্কে এমন
তিনটি বিষয়ের আলোচনা এসেছে যা মনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে, তাই
আমরা সে ব্যাপারটিও পরিষ্কার করে দিতে চাই। এর মধ্যে সর্বপ্রথম যে বিষয়টির
প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় সেটি হচ্ছে, এ সূরা দু’টির কুরআনের অংশ হবার
ব্যাপারটি কি চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত অথবা এর মধ্যে কোন প্রকার সংশয়ের অবকাশ
আছে? এ প্রশ্ন দেখা দেবার কারণ হচ্ছে এই যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের
মতো উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবী থেকে বিভিন্ন রেওয়ায়েতে একথা উদ্ধৃত
হয়েছে যে, তিনি এ সূরা দু’টিকে কুরআনের সূরা বলে মানতেন না এবং নিজের
পাণ্ডুলিপিতে তিনি এ দু’টি সূরা সংযোজিত করেননি। ইমাম আহমাদ, বাযযার,
তাবারানী, ইবনে মারদুইয়া, আবু ইয়ালা, আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বল,
হুমাইদী, আবু নু’আইয, ইবনে হিব্বান প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন সূত্রে এবং
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সহীহ সনদের মাধ্যমে একথা হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে
উদ্ধৃত করেছেন। এ হাদীসগুলোতে কেবল একথাই বলা হয়নি যে, তিনি এই সূরা
দু’টিকে কুরআনের পাণ্ডুলিপি থেকে বাদ দিতেন বরং এই সাথে একথাও বলা হয়েছে
যে, তিনি বলতেনঃ “কুরআনের সাথে এমন জিনিস মিশিয়ে ফেলো না যা কুরআনের অংশ
নয়। এ সূরা দু’টি কুরআনের অন্তর্ভুক্ত নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামকে এর মাধ্যমে একটি হুকুম দেয়া হয়েছিল। তাঁকে বলা হয়েছিল, এ
শব্দগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও।” কোন কোন রেওয়ায়াতে আরো বাড়তি
বলা হয়েছে যে, তিনি নামাযে এ সূরা দু’টি পড়তেন না।
এ রেওয়ায়াতগুলোর কারণে ইসলাম বিরোধীরা কুরআনের বিরুদ্ধে সন্দেহ সৃষ্টির এবং
(নাউযুবিল্লাহ) কুরআন যে বিকৃতি মুক্ত নয় একথা বলার সুযোগ পেয়ে গেছে। বরং
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রাঃ) মতো বড় সাহাবী যখন এই মত পোষণ করছেন যে,
কুরআনের এ দু’টি সূরা বাইরে থেকে তাতে সংযোজিত হয়েছে তখন না জানি তার মধ্যে
আরো কত কি পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়েছে। এ ধরনের সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টির
সুযোগ তারা সহজেই পেয়ে গেছে। কুরআনকে এ ধরনের দোষারোপ মুক্ত করার জন্য কাযী
আবু বকর বাকেল্লানী ও কাযী ইয়ায, ইবনে মাসউদের বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যা
দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ইবনে মাসউদ সূরা ফালাক ও সূরা নাসের কুরআনের অংশ
হবার ব্যাপারটি অস্বীকার করতেন না বরং তিনি শুধু এ সূরা দু’টিকে কুরআনের
পাতায় লিখে রাখতে অস্বীকার করতেন। কারণ তাঁর মতে কুরআনের পাতায় শুধুমাত্র
তাই লিখে রাখা উচিত যা লিখার অনুমতি রসূলুল্লাহ ﷺ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এ
জবাব ও ব্যাখ্যা সঠিক নয়। কারণ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এ সূরা দু’টির কুরআনের
সূরা হওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন, একথা নির্ভরযোগ্য সনদের মাধ্যমে প্রমাণিত।
ইমাম নববী, ইমাম ইবনে হাযম, ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী প্রমুখ অন্য কতিপয় মনীষী
ইবনে মাসউদ যে এ ধরনের কোন কথা বলেছেন, এ কথাটিকেই সরাসরি মিথ্যা ও বাতিল
গণ্য করেছেন। কিন্তু নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সত্যকে সনদ ছাড়াই রদ করে দেয়া
কোন সুস্থ জ্ঞানসম্মত পদ্ধতি নয়।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়, ইবনে মাসউদ (রাঃ) সংক্রান্ত এ রেওয়ায়াত থেকে কুরআনের
প্রতি যে দোষারোপ হচ্ছে তার জবাব কি? এ প্রশ্নের কয়েকটি জবাব আমরা এখানে
পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করেছি।
একঃ হাফেয বাযযার তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে ইবনে মাসউদ (রাঃ) সংক্রান্ত এ
রেওয়ায়াতগুলো বর্ণনা করার পর লিখেছেনঃ নিজের এ রায়ের ব্যাপারে তিনি একান্তই
নিঃসঙ্গ ও একাকী। সাহাবীদের একজনও তাঁর এ বক্তব্য সমর্থন করেননি।
দুইঃ সকল সাহাবী একমত হওয়ার ভিত্তিতে তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু
আনহু কুরআন মজীদের যে অনুলিপি তৈরি করেছিলেন এবং ইসলামী খেলাফতের পক্ষ থেকে
ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন কেন্দ্রে সরকারী পর্যায়ে পঠিয়েছিলেন তাতে এ দু’টি
সূরা লিপিবদ্ধ ছিল।
তিনঃ রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর মুবারক যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সমগ্র ইসলামী
দুনিয়ায় কুরআনের যে কপির ওপর সমগ্র মুসলিম উম্মাহ একমত তাতেই সূরা দু’টি
লিখিত আছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদের (রাঃ) একক রায় তাঁর বিপুল ও উচ্চ
মর্যাদা সত্ত্বেও সমগ্র উম্মাতের এ মহান ইজমার মোকাবেলায় কোন মূল্যই রাখে
না।
চারঃ রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর অত্যন্ত নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য হাদীস অনুযায়ী একথা
প্রমাণিত হয় যে, তিনি নামাযে এ সূরা দু’টি নিজে পড়তেন, অন্যদের পড়ার আদেশ
দিতেন এবং কুরআনের সূরা হিসেবেই লোকদেরকে এ দু’টির শিক্ষা দিতেন। উদাহরণ
স্বরূপ নিম্নোক্ত হাদীসগুলো দেখুন।
ইতিপূর্বে মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী ও নাসাঈর বরাত দিয়ে আমরা হযরত উকবা ইবনে
আমেরের (রাঃ) একটি রেওয়ায়াত বর্ণনা করেছি। এতে রসূলুল্লাহ্ ﷺ সূরা ফালাক ও
সূরা নাস সম্পর্কে তাঁকে বলেনঃ আজ রাতে এ আয়াতগুলো আমার ওপর নাযিল হয়েছে।
উকবা ইবনে আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত নাসায়ীর এক রেওয়ায়াতে বলা হয়েছেঃ
রসূলুল্লাহ্ ﷺ এ দু’টি সূরা ফজরের নামাযে পড়েন। ইবনে হিব্বানও এই হযরত
উকবা ইবনে আমের (রাঃ) থেকে রেওয়ায়াত করেছেন, নবী করীম ﷺ তাঁকে বলেনঃ “যদি
সম্ভব হয় তোমার নামাযসমূহ থেকে এ সূরা দু’টির পড়া যেন বাদ না যায়।” সাঈদ
ইবনে মনসুর হযরত মু’আয ইবনে জাবালের রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা
হয়েছে, নবী করিম ﷺ ফজরের নামাযে এ সূরা দু’টি পড়েন। ইমাম আহমাদ তাঁর
মুসনাদে সহীহ সনদ সহকারে আরো একজন সাহাবীর হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা
হয়েছে, নবী ﷺ তাঁকে বলেনঃ যখন তুমি নামায পড়বে, তাতে এ দু’টি সূরা পড়তে
থাকবে। মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ ও নাসাঈতে উকবা ইবনে আমেরের (রাঃ) একটি
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ তাঁকে বলেনঃ “লোকেরা
যে সূরাগুলো পড়ে তার মধ্যে সর্বোত্তম দু’টি সূরা কি তোমাকে শেখাবো না? তিনি
আরজ করেন, অবশ্যি শিখাবেন। হে আল্লাহ রসূল ﷺ ! একথায় তিনি তাঁকে এ আল
ফালাক ও আন নাস সূরা দু’টি পড়ান। তারপর নামায দাঁড়িয়ে যান এবং নবী করীম ﷺ এ
সূরা দু’টি তাতে পড়েন। নামায শেষ করে তিনি তাঁর কাছ দিয়ে যাবার সময় বলেনঃ
“হে উকাব (উকবা)! কেমন দেখলে তুমি?” এরপর তাঁকে হিদায়াত দিলেন, যখন তুমি
ঘুমাতে যাও এবং যখন ঘুম থেকে জেগে উঠো তখন এ সূরা দু’টি পড়ো।” মুসনাদে
আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈতে উকবা ইবনে আমেরের (রাঃ) অন্য একটি
রেওয়ায়াতে বলা হয়েছেঃ রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে প্রত্যেক নামাযের পর “মু’আওবিযাত”
(অর্থাৎ সূরা ইখলাস, সূরা আল ফালাক ও সূরা আন নাস) পড়তে বলেন। নাসায়ী ইবনে
মারদুইয়ার এবং হাকেম উকবা ইবনে আমেরের আর একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন।
তাতে বলা হয়েছেঃ একবার নবী করিম ﷺ সওয়ারীর পিঠে চড়ে যাচ্ছিলেন এবং আমি তাঁর
পবিত্র পায়ে হাত রেখে সাথে সাথে যাচ্ছিলাম। আমি বললাম, আমাকে কি সূরা হূদ,
সূরা ইউসুফ শিখিয়ে দেবেন? বললেনঃ “আল্লাহর কাছে বান্দার জন্য ‘কুল আউজু বি
রব্বিল ফালাক’ ---এর চাইতে বেশী বেশী উপকারী আর কোন জিনিস নেই।” নাসাঈ,
বায়হাকী, বাগাবী ও ইবনে সা’দ, আবদুল্লাহ ইবনে আবেস আল জুহানীর রেওয়ায়াত
উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, নবী করিম ﷺ আমাকে বলেছেনঃ “ইবনে আবেস, আমি
কি তোমাকে জানাবো না, আশ্রয় প্রার্থীরা যতগুলো জিনিসের মাধ্যমে আল্লাহর
কাছে আশ্রয় চেয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কোনগুলো?” আমি বললাম, অবশ্যি
বলবেন হে আল্লাহর রসূল! বললেনঃ “কূল আউযু বিরব্বিল ফালাক” ও “কুল আউযু
বিরব্বিন নাস” সূরা দু’টি।” ইবনে মারদুইয়া, হযরত ইবনে সালমার রেওয়ায়াত
উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ যে সূরাগুলো সবচেয়ে বেশী পছন্দ
করেন তা হচ্ছে, কুল আউযু বিরব্বিল ফালাক ও কুল আউযু বিরব্বিন নাস।”
এখানে প্রশ্ন দেখা যায়, এ দু’টি কুরআন মজীদের সূরা নয়, হযরত আবদুল্লাহ্
ইবনে মাসউদ (রাঃ) এ ধরনের ভুল ধারণার শিকার হলেন কেমন করে? দু’টি বর্ণনা
একত্র করে দেখলে আমরা এর জবাব পেতে পারি।
একটি বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলতেন, এটিতো
আল্লাহর একটি হুকুম ছিল। রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে হুকুম দেয়া হয়েছিল, আপনি এভাবে
আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান। অন্য বর্ণনাটি বিভিন্ন সূত্রে উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম
বুখারী সহীহ আল বুখারীতে, ইমাম মুহাম্মাদ তাঁর মুসনাদে, হাফেজ আবু বকর আল
হুমাইদী তাঁর মুসনাদে, আবু নু’আইম তাঁর আল মুসতাখরাজে এবং নাসাঈ তাঁর
সুনানে যির ইবনে হুবাইশের বরাত দিয়ে সামান্য শাব্দিক পরিবর্তন সহকারে
কুরাআনী জ্ঞানের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী
হযরত উবাই ইবনে কা’ব থেকে এটি উদ্ধৃত করেছেন। যির ইবনে হুবাইশ বর্ণনা
করেছেন, আমি হযরত উবাইকে (রাঃ) বললাম, আপনার ভাই আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ তো
এমন এমন কথা বলেন। তাঁর এ উক্তি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি? তিনি জবাব
দিলেনঃ “আমি এ সম্পর্কে রসূলূল্লাহ্ ﷺ কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। রসূলুল্লাহ্ ﷺ
বলেন, আমাকে বলা হয়েছে, ‘কুল’ (বলো, কাজেই আমি বলেছি ‘কুল’। তাই আমরাও
তেমনিভাবে বলি যেভাবে রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলতেন।” ইমাম আহমাদের বর্ণনা মতে হযরত
উবাইয়ের বক্তব্য ছিল নিম্নরূপঃ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, রসূলুল্লাহ্ ﷺ আমাকে
বলেছেন, জিব্রীল আলাইহিস সালাম তাঁকে বলেছিলেন, কুল আউযু বিরব্বিল ফালাক”
তাই তিনিও তেমনি বলেন। আর জিব্রীল (আঃ) ‘কুল আউযু বিরব্বিন নাস’ বলেছিলেন,
তাই তিনিও তেমনি বলেন। কাজেই রসূল ﷺ যেভাবে বলতেন আমরাও তেমনি বলি।” এ
দু’টি বর্ণনা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, হযরত আবদুল্লাহ
ইবনে মাসউদ (রাঃ) উভয় সূরায় ‘কুল’ (বলো) শব্দ দেখে এ ভুল ধারণা করেছিলেন
যে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে “আউযু বিরব্বিল ফালাক (আমি সকাল বেলার রবের আশ্রয়
চাচ্ছি) ও “আউযু বিরব্বিন নাস” (আমি সমস্ত মানুষের রবের আশ্রয় চাচ্ছি) বলার
হুকুম দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি রসূলে করিমকে ﷺ এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার
প্রয়োজন অনুভব করেননি। হযরত উবাই ইবনে কা’বের (রাঃ) মনে এ সম্পর্কে প্রশ্ন
জেগেছিল। তিনি রসূলের ﷺ সামনে প্রশ্ন রেখেছিলেন। রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছিলেনঃ
জিব্রীল আলাইহিস সালাম যেহেতু ‘কুল’ বলেছিলেন তাই আমিও ‘কুল’ বলি। একথাটিকে
এভাবেও ধরা যায় যদি কাউকে হুকুম দেয়ার উদ্দেশ্য থাকে এবং তাকে বলা হয়,
“বলো, আমি আশ্রয় চাচ্ছি।” বরং সেক্ষেত্রে ‘বলো’ শব্দটি বাদ দিয়ে “আমি আশ্রয়
চাচ্ছি” বলবে। বিপরীতপক্ষে যদি ঊর্ধ্বতন শাসকের সংবাদবাহক কাউকে এভাবে খবর
দেয়, “বলো, আমি আশ্রয় চাচ্ছি” এবং এ পয়গাম তার নিজের কাছে রেখে দেবার জন্য
নয় বরং অন্যদের কাছেও পৌঁছে দেবার জন্য দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে তিনি লোকদের
কাছে এ পয়গামের শব্দগুলো, হুবহু পৌঁছে দেবেন। এর মধ্য থেকে কোন একটি শব্দ
বাদ দেবার অধিকার তাঁর থাকবে না। কাজেই এ সূরা দু’টির সূচনা ‘কুল’ শব্দ
দিয়ে করা একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, এটি অহীর কালাম এবং কালামটি
রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর ওপর যেভাবে নাযিল হয়েছিল ঠিক সেভাবেই লোকদের কাছে
পৌঁছিয়ে দিতে তিনি বাধ্য ছিলেন। এটি শুধু নবী ﷺ কে দেয়া একটি হুকুম ছিল না।
কুরআন মজীদে এ দু’টি সূরা ছাড়াও এমন ৩৩০টি আয়াত আছে যেগুলো ‘কুল’ শব্দ
দিয়ে শুরু করা হয়েছে। এ আয়াতগুলোতে ‘কুল’ (বলো) থাকা একথাই সাক্ষ্য বহন করে
যে, এগুলো অহীর কালাম এবং যেসব শব্দ সহকারে এগুলো নবী করিম ﷺ ---এর ওপর
নাযিল হয়েছিল হুবহু সেই শব্দগুলো সহকারে লোকদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া তাঁর
জন্য ফরয করা হয়েছিল। নয়তো প্রত্যেক জায়গায় ‘কুল’ (বলো) শব্দটি বাদ দিয়ে
শুধু সেই শব্দগুলোই বলতেন যেগুলো বলার হুকুম তাঁকে দেয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে
তিনি এগুলো কুরআনে সংযোজিত করতেন না। বরং এ হুকুমটি পালন করার জন্য
শুধুমাত্র সেই কথাগুলোই বলে দেয়া যথেষ্ট মনে করতেন যেগুলো বলার হুকুম তাঁকে
দেয়া হয়েছিল।
এখানে সামান্য একটু চিন্তা-ভাবনা করলে একথা ভালোভাবে অনুধাবন করা যেতে পারে
যে, সাহাবায়ে কেরামকে ভুল ত্রুটি মুক্ত মনে করা এবং তাদের কোন কথা
সম্পর্কে ‘ভুল’ শব্দটি শুনার সাথে সাথেই সাহাবীদের অবমাননা করা হয়েছে বলে
হৈ চৈ শুরু করে দেয়া কতই না অর্থহীন। এখানে দেখা যাচ্ছে, হযরত আবদুল্লাহ্
ইবনে মাসউদ (রাঃ)- এর মত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবীর কুরআনের দু’টি সূরা
সম্পর্কে কত বড় একটি ভুল হয়ে গেছে। এতবড় উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবীর যদি
এমনি একটি ভুল হয়ে যেতে পারে তাহলে অন্যদেরও কোন ভুল হয়ে যাওয়া সম্ভব। আমরা
ইলমী তথা তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য এ ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করতে পারি। তবে
যে ব্যক্তি ভুলকে ভুল বলার পর আবার সামনে অগ্রসর হয়ে তাঁদের প্রতি ধিক্কার ও
নিন্দাবাদে মুখর হবে সে হবে একজন মস্ত বড় জালেম। এ “মু’আওবিযাতাইন”
প্রসঙ্গে মুফাস্সির ও মুহাদ্দিসগণ হযরত ইবনে মাসউদ (রা) এর রায়কে ভুল
বলেছেন। কিন্তু তাঁদের কেউই কথা বলার দুঃসাহস করেননি যে, (নাউযুবিল্লাহ্)
কুরআনের দু’টি সূরা অস্বীকার করে তিনি কাফের হয়ে গিয়েছিলেন।
নবী করীমের (সাঃ) ওপর যাদুর প্রভাব
এ সূরাটির ব্যাপারে আরেকটি প্রশ্ন দেখা। হাদীস থেকে জানা যায়, রসূলুল্লাহ্
ﷺ এর ওপর যাদু করা হয়েছিল। তার প্রভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এ যাদুর
প্রভাব দূর করার জন্য জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এসে তাঁকে এ সূরা দু’টি পড়ার
নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রাচীন ও আধুনিক বুদ্ধিবাদীদের অনেকে এ ব্যাপারটির
বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করেছেন। তারা বলেছেন, এ হাদীসগুলো মেনে নিলে সমস্ত
শরীয়াতটাই সন্দেহযুক্ত হয়ে যায়। কারণ, নবীর ওপর যদি যাদুর প্রভাব পড়তে
পারে এবং এ হাদীসগুলোর দৃষ্টিতে তাঁর ওপর যাদুর প্রভাব পড়েছিল, তাহলে আমরা
জানি না বিরোধীরা যাদুর প্রভাব ফেলে তাঁর মুখ থেকে কতো কথা বলিয়ে এবং তাঁকে
দিয়ে কত কাজ করিয়ে নিয়েছে। আর তাঁর প্রদত্ত শিক্ষার মধ্যেই বা কি পরিমাণ
জিনিস আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং কতটা যাদুর প্রভাবে ছিল তাও আমরা জানি না। বরং
তাদের বক্তব্য হচ্ছে, একথা সত্য বলে মেনে নেয়ার পর যাদুরই মাধ্যমে নবীকে
নবুওয়াতের দাবি করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল কি না এবং যাদুরই প্রভাবে তিনি
বিভ্রান্তির শিকার হয়ে তাঁর কাছে ফেরেশতা এসেছে বলে মনে করেছিলেন কিনা
একথাও নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে না। তাদের আরো যুক্তি হচ্ছে, এ হাদীসগুলো
কুরআন মজীদের সাথে সংঘর্ষশীল। কারণ, কুরআন মজীদে কাফেরদের এ অভিযোগ বর্ণনা
করা হয়েছে যে, তারা নবীকে যাদুগ্রস্ত ব্যক্তি বলেছেঃ
আরবী-----------------------
“জালেমরা বলে, তোমরা নিছক একজন যাদুগ্রস্ত ব্যক্তির আনুগত্য করে চলছো।”
(বনি ইসরাঈল, ৪৭) আর এ হাদীসগুলো কাফেরদের এ অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণ করেছে।
অর্থাৎ এ হাদীসগুলো থেকে প্রমাণ হচ্ছে সত্যিই নবীর ﷺ ওপর যাদু করা হয়েছিল।
এ বিষয়টির ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হলে সর্বপ্রথম
দেখতে হবে, মূলতঃ রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর ওপর যাদুর প্রভাব পড়েছিল বলে কি সহীহ ও
নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনায় প্রমাণিত হয়েছে? আর যদি প্রমাণিত হয়ে থাকে
তাহলে তা কি ছিল এবং কতটুকু ছিল? তারপর যেসব আপত্তি করা হয়েছে, ইতিহাস থেকে
প্রমাণিত বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে সেগুলো উত্থাপিত হতে পারে কি না, তা দেখতে
হবে।
প্রথম যুগের মুসলিম আলেমগণ নিজেদের চিন্তা ও ধারণা অনুযায়ী ইতিহাস বিকৃত
অথবা সত্য গোপন করার প্রচেষ্টা না চালিয়ে চরম সততা ও নিষ্ঠার পরিচয়
দিয়েছেন। বরং যা কিছু ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয়েছে তাকে হুবহু পরবর্তী
প্রজন্মের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। এ সত্যগুলো থেকে যদি কেউ বিপরীত ফলাফল
গ্রহণে উদ্যোগী হয় তাহলে তাদের সংগৃহীত এ উপাদানগুলোর সাহায্যে সে যে
বিপুলভাবে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে পারবে এ সম্ভাবনার কোন পরোয়াই তারা
করেননি। এখন যদি কোন একটি কথা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বিপুল সংখ্যক ঐতিহাসিক
তথ্য বিবরণীর ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়, তাহলে তা মেনে নিলে অমুক অমুক ত্রুটি ও
অনিষ্টকারিতা দেখা দেবে এ অজুহাত দেখিয়ে ইতিহাসকে মেনে নিতে অস্বীকার করা
কোন ন্যায়নিষ্ঠ পণ্ডিত ও জ্ঞানী লোকের কাজ হতে পারে না। অনুরূপভাবে ইতিহাস
থেকে যতটুকু সত্য বলে প্রমাণিত হয় তার ওপর কল্পনার ঘোড়া দৌড়িয়ে তাকে ফুলিয়ে
ফাঁপিয়ে নিজের আসল আকৃতি থেকে অনেকগুণ বাড়িয়ে পেশ করাও ঐতিহাসিক সততার
পরিচায়ক নয়। এর পরিবর্তে ইতিহাসকে ইতিহাস হিসেবে মেনে নিয়ে তার মাধ্যমে কি
প্রমাণ হয় ও কি প্রমাণ হয় না তা দেখাই তার কাজ।
ঐতিহাসিক তথ্য বিবরণী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নবী ﷺ এর ওপর যাদুর প্রভাব
চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত। তাত্ত্বিক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাকে
যদি ভুল প্রমাণ করা যেতে পারে তাহলে দুনিয়ার কোন একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকেও
সঠিক প্রমাণ করা যাবে না। হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) ও
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, ইবনে
মাজাহ, ইমাম আহমাদ, আবদুর রাজ্জাক, হুমাইদী, বায়হাকী, তাবরানী, ইবনে
মারদুইয়া, ইবনে সা’দ, ইবনে আবী শাইবা, হাকেম, আবদ ইবনে হুমাইদ প্রমুখ
মুহাদ্দিসগণ এত বিভিন্ন ও বিপুলসংখ্যক সনদের মাধ্যমে এ ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন
যে, এর এক একটি বর্ণনা, ‘খবরে ওয়াহিদ’- এর পর্যায়ভুক্ত হলেও মূল
বিষয়বস্তুটি ‘মুতাওয়াতির’ বর্ণনার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন হাদীসে এর
যে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে সেগুলো একত্র করে এবং একসাথে গ্রন্থিত ও সুসংবদ্ধ
করে সাজিয়ে গুছিয়ে আমরা এখানে একটি ঘটনা আকারে তুলে ধরছি।
হোদায়বিয়ার সন্ধির পর নবী ﷺ মদীনায় ফিরে এলেন। এ সময় সপ্তম হিজরীর মহররম
মাসে খয়বর থেকে ইহুদীদের একটি প্রতিনিধি দল মদীনায় এলো। তারা আনসারদের বনি
যুরাইক গোত্রের বিখ্যাত যাদুকর লাবীদ ইবনে আ’সমের সাথে সাক্ষাত করলো।১ (পাদ
টীকা দেখুন) তারা তাকে বললো, মুহাম্মাদ ﷺ আমাদের সাথে যা কিছু করেছেন তা
তো তুমি জানো। আমরা তাঁর ওপর অনেকবার যাদু করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সফল
হতে পারেনি। এখন তোমার কাছে এসেছি। কারণ তুমি আমাদের চাইতে বড় যাদুকর।
তোমার জন্য এ তিনটি আশরাফী (স্বর্ণ মুদ্রা) এনেছি। এগুলো গ্রহণ করো এবং
মুহাম্মাদের ﷺ ওপর একটি শক্ত যাদুর আঘাত হানো। এ সময় একটি ইহুদী ছেলে
রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর কাছে কাজ করতো। তার সাথে যোগসাজশ করে তারা রসূলুল্লাহ্ ﷺ
চিরুনীর একটি টুকরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হলো। তাতে তাঁর পবিত্র চুল আটকানো
ছিল। সেই চুলগুলো ও চিরুনীর দাঁতের ওপর যাদু করা হলো। কোন কোন বর্ণনায় বলা
হয়েছে, লাবীদ ইবনে আ’সম নিজেই যাদু করেছিল। আবার কোন কোন বর্ণনায় বলা
হয়েছে-- তার বোন ছিল তার চেয়ে বড় যাদুকর। তাদের সাহায্যে সে যাদু করেছিল।
যাহোক এ দু’টির মধ্যে যে কোন একটিই সঠিক হবে। এক্ষেত্রে এ যাদুকে একটি
পুরুষ খেজুরের ছড়ার আবরণের২ (পাদ টীকা দেখুন) নীচে রেখে লাবীদ সেটাকে বনী
যুরাইকের যারওয়ান বা যী-আযওয়ান নামক কুয়ার তলায় একটি পাথর চাপা দিয়ে রাখলো।
নবী ﷺ এর ওপর প্রভাব পড়তে পূর্ণ এক বছর সময় লাগলো। বছরের শেষ ছয় মাসে
মেজাজে কিছু পরিবর্তন অনুভূত হতে থাকলো। শেষ চল্লিশ দিন কঠিন এবং শেষ তিন
দিন কঠিনতর হয়ে গেলো। তবে এর সবচেয়ে বেশী যে প্রভাব তাঁর ওপর পড়লো তা কেবল
এতটুকুই যে, দিনের পর দিন তিনি রোগা ও নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলেন। কোন কাজের
ব্যাপারে মনে করতেন, করে ফেলেছেন অথচ তা করেননি। নিজের স্ত্রীদের সম্পর্কে
মনে করতেন, তিনি তাদের কাছে গেছেন অথচ আসলে তাদের কাছে যাননি। আবার কোন কোন
সময় নিজের দৃষ্টির ব্যাপারেও তাঁর সন্দেহ হতো। মনে করতেন কোন জিনিস
দেখেছেন অথচ আসলে তা দেখেননি। এসব প্রভাব তাঁর নিজের ব্যক্তিসত্ত্বা
পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি তাঁর ওপর দিয়ে কি ঘটে যাচ্ছে তা অন্যেরা
জানতেও পারেনি।
পাদ টীকাঃ ১. কোন কোন বর্ণনাকারী তাকে ইহুদী বলেছেন। আবার কেউ
বলেছেন, মুনাফিক ও ইহুদীদের মিত্র। তবে এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, সে ছিল
বনী যুরাইকের অন্তর্ভুক্ত। আর বনী যুরাইক ইহুদীদের কোন গোত্র ছিল না, একথা
সবাই জানে। বরং এটি ছিল খাযরাজদের অন্তর্ভুক্ত আনসারদের একটি গোত্র। তাই
বলা যেতে পারে, সে মদীনাবাসী ছিল, কিন্তু ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করেছিল অথবা
ইহুদীদের সাথে চুক্তিবদ্ধ সহযোগী হবার কারণে কেউ কেউ তাকে ইহুদী মনে করে
নিয়েছিল। তবুও তার জন্য মুনাফিক শব্দ ব্যবহার করার কারণে জানা যায়, বাহ্যত
সে নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দিতো।
২. শুরুতে খেজুরের ছড়া একটি আবরণের মধ্যে থাকে। পুরুষ খেজুরের আবরণের রং হয়
মানুষের রংয়ের মতো। তার গন্ধ হয় মানুষের শুক্রের গন্ধের মতো।
---------------- পাদ টীকা সমাপ্ত-----------
কিন্তু নবী হিসেবে তাঁর ওপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তায় তার মধ্যে
সামান্যতম ব্যাঘাতও সৃষ্টি হতে পারেনি। কোন একটি বর্ণনায়ও একথা বলা হয়নি
যে, সে সময় তিনি কুরআনের কোন আয়াত ভুলে গিয়েছিলেন। অথবা কোন আয়াত ভুল
পড়েছিলেন। কিংবা নিজের মজলিসে, বক্তৃতায় ও ভাষণে তাঁর শিক্ষাবলীতে কোন
পার্থক্য সূচিত হয়েছিল। অথবা এমন কোন কালাম তিনি অহী হিসেবে পেশ করেছিলেন
যা আসলে তাঁর ওপর নাযিল হয়নি। কিংবা তাঁর কোন নামায তরক হয়ে গেছে এবং সে
সর্ম্পকে তিনি মনে করেছেন যে, তা পড়ে নিয়েছেন অথচ আসলে তা পড়েননি।
নাউযুবিল্লাহ্, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটে গেলে চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যেতো। সারা
আরব দেশে খবর ছড়িয়ে পড়তো, যে নবীকে কেউ কাৎ করতে পারেনি, একজন যাদুকরের
যাদুর কাছে সে কাৎ হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর নবুওয়াতের মর্যাদা এ অবস্থায়
পুরোপুরি সমুন্নত থেকেছে। তার ওপর কোন প্রভাব পড়েনি। কেবলমাত্র নিজের
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এ জিনিসটি অনুভব করে পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন। শেষে
একদিন তিনি হযরত আয়েশার (রাঃ) কাছে ছিলেন। এ সময় বার বার আল্লাহর কাছে দোয়া
চাইতে থাকলেন। এ অবস্থায় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন অথবা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন।
জেগে উঠে হযরত আয়েশাকে (রাঃ) বললেন, আমি যে কথা আমার রবের কাছে জিজ্ঞেস
করেছিলাম তা তিনি আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন,
কি কথা? জবাব দিলেন, “দু’জন লোক (অর্থাৎ দু’জন ফেরেশতা দু’জন লোকের আকৃতি
ধরে আমার কাছে এলো। একজন ছিল মাথার দিকে, আরেকজন পায়ের দিকে। একজন জিজ্ঞেস
করলো, এঁর কি হয়েছে? অন্যজন জবাব দিল, এঁর ওপর যাদু করা হয়েছে। প্রথম জন
জিজ্ঞেস করলো, কে করেছে? জবাব দিল, লাবীত ইবনে আ’সম। জিজ্ঞেস করলো, কোন্
জিনিসের মধ্যে করেছে? জবাব দিল, একটি পুরুষ খেজুরের ছড়ার আবরণে আবৃত চিরুনী
ও চুলের মধ্যে। জিজ্ঞেস করলো, তা কোথায় আছে? জবাব দিল, বনী যারাইকের কূয়া
যী-আযওয়ানের (অথবা যী-যারওয়ান) তলায় পাথর চাপা দেয়া আছে। জিজ্ঞেস করলো,
তাহলে এখন এজন্য কি করা দরকার? জবাব দিল, কুয়ার পানি সেঁচে ফেলতে হবে।
তারপর পাথরের নিচ থেকে সেটি বের করে আনতে হবে। এরপর নবী ﷺ হযরত আলী (রাঃ)
হযরত ইবনে ইয়াসির (রাঃ) ও হযরত যুবাইরকে (রাঃ) পাঠালেন। তাদের সাথে শামিল
হলেন হযরত জুবাইর ইবনে ইয়াস আযযুরাকী ও কায়েস ইবনে মিহসান আযযুরাকী (অর্থাৎ
বনি যুরাইকের দুই ব্যক্তি)। পরে নবী ﷺ নিজেও কয়েকজন সাহাবীকে সাথে নিয়ে
সেখানে পৌঁছে গেলেন। পানি তোলা হলো। কুয়ার তলা থেকে কথিত আবরণটি বের করে
আনা হলো। তার মধ্যে চিরুনী ও চুলের সাথে মিশিয়ে রাখা একটি সূতায় এগারোটি
গিরা দেয়া ছিল। আর ছিল মোমের একটি পুতুল। তার গায়ে কয়েকটি সুঁই ফুটানো ছিল।
জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এসে বললেন, আপনি সূরা আল ফালাক ও আন নাস পড়ুন।
কাজেই তিনি এক একটি আয়াত পড়ে যাচ্ছিলেন এবং সেই সাথে এক একটি গিরা খুলে
যাচ্ছিল এবং পুতুলের গা থেকে এক একটি সুঁইও তুলে নেয়া হচ্ছিল। সূরা পড়া শেষ
হতেই সমস্ত গিরা খুলে গেলো, সমস্ত সুঁই উঠে এলো এবং তিনি যাদুর
প্রভাবমুক্ত হয়ে ঠিক এমন অবস্থায় পৌঁছে গেলেন যেমন কোন ব্যক্তি রশি দিয়ে
বাঁধা ছিল তারপর তার বাঁধন খুলে গেলো। তারপর তিনি লাবীদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ
করলেন। সে তার দোষ স্বীকার করলো এবং তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন। কারণ, নিজের
ব্যক্তিসত্ত্বার জন্য তিনি কোনদিন কারো ওপর প্রতিশোধ নেননি।
শুধু এই নয়, তিনি এ বিষয়টি নিয়ে কোন কথাবার্তা বলতেও অস্বীকৃতি জানালেন।
কারণ তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে রোগমুক্ত করেছেন, কাজেই এখন আমি কারো
বিরুদ্ধে লোকদের উত্তেজিত করতে চাই না।
এ হলো এ যাদুর কাহিনী। এর মধ্যে এমন কোন বিষয় নেই যা তাঁর নবুওয়াতের
মর্যাদার মধ্যে কোন প্রকার ত্রুটি সৃষ্টি করতে পারে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যদি
তাঁকে আহত করা যেতে পারে, যেমন ওহোদের যুদ্ধে হয়েছিল, যদি তিনি ঘোড়ার পিঠ
থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়ে পড়েন, যেমন বিভিন্ন হাদীস থেকে প্রমাণিত, যদি তাঁকে
বিচ্ছু কামড় দেয়, যেমন অন্যান্য হাদীসে পাওয়া যায় এবং নবী হবার জন্য মহান
আল্লাহ তাঁর সাথে যে সংরক্ষণের ওয়াদা করেছিলেন, যদি এগুলোর মধ্য থেকে কোন
একটিও তার পরিপন্থী না হয়ে থাকে, তাহলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি যাদুর
প্রভাবে অসুস্থ হতেও পারেন। এতে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। নবীর ওপর যাদুর
প্রভাব পড়তে পারে, একথা কুরআন মজীদ থেকেও প্রমাণিত। সূরা আ’রাফেও ফেরাউনের
যাদুকরদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ হযরত মুসা (আঃ) এর মোকাবিলায় তারা এলো। তারা
সেখানে এ মোকাবিলা দেখতে উপস্থিত হাজার হাজার লোকের দৃষ্টিশক্তির ওপর যাদু
করলো (আরবী------------------)। সূরা ত্ব-হায় বলা হয়েছেঃ তারা যেসব লাঠি ও
রশি দিয়েছিল সেগুলো সম্পর্কে শুধু সাধারণ লোকেরাই নয়, হযরত মূসা (আঃ)ও মনে
করলেন সেগুলো সাপের মতো তাঁর দিকে দৌঁড়ে আসছে এবং তিনি এতে ভীত হয়ে পড়লেন।
এমন কি মহান আল্লাহ তাঁর ওপর এই মর্মে অহী নাযিল করলেন যে, ভয় পেয়ো না,
তুমি বিজয়ী হবে। তোমার লাঠিটা একটু ছুঁড়ে ফেলো।
আরবী----------------------------
এখানে যদি আপত্তি উত্থাপন করে বলা হয়, এ ধরনের বিশ্লেষণের মাধ্যমে মক্কার
কাফেরদের দোষারোপকেই সত্য প্রমাণ করা হলো। তারা তো নবী ﷺ কে যাদুগ্রস্ত
ব্যক্তি বলতো। এর জবাবে বলা যায়, তিনি কোন যাদুকরের যাদুর প্রভাবে অসুস্থ
হয়ে পড়েছিলেন এ অর্থে মক্কার কাফেররা তাঁকে যাদুগ্রস্ত ব্যক্তি বলতো না।
বরং তাঁকে যাদুর প্রভাব পাগল করে দিয়েছিল এবং নবুওয়াতের দাবি ছিল তাঁর এ
পাগলামীরই বহিঃপ্রকাশ। আর এ পাগলামীর বশবর্তী হয়েই তিনি জান্নাত ও
জাহান্নামের গল্প শুনিয়ে যেতেন। একথা সুস্পষ্ট, যে বিষয় ইতিহাস থেকে
প্রমাণিত, যে যাদুর প্রভাব শুধুমাত্র মুহাম্মাদ ﷺ এর ব্যক্তিসত্ত্বার ওপর
পড়েছিল, তাঁর নবীসত্ত্বা ছিল এর আওতার সম্পূর্ণ বাইরে। তেমন ধরনের কোন
বিষয়ের সাথে এ আপত্তি সম্পৃক্ত হতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে একথাও উল্লেখযোগ্য, যারা যাদুকে নিছক কাল্পনিক জিনিস মনে করেন,
যাদুর প্রভাবের কোন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সম্ভবপর নয় বলেই তারা এ ধরনের মত
পোষণ করেন। কিন্তু দুনিয়ায় এমন বহু জিনিসই রয়েছে যেগুলো অভিজ্ঞতা ও
পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে, কিন্তু সেগুলো কিভাবে হয়, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তার
বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। এ ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার অক্ষমতার ফলে একথা
অপরিহার্য হয়ে ওঠে না যে, আমরা যে জিনিসটি বিশ্লেষণ করতে অক্ষম সেটিকে
আমাদের অস্বীকার করতে হবে। আসলে যাদু একটি মনঃস্তাত্বিক প্রভাব। শারীরিক
প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিগুলো যেভাবে শরীরের সীমা অতিক্রম করে মনকে
প্রভাবিত করে, ঠিক তেমনি যাদুর প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিও মনের সীমা পেরিয়ে
শরীরকেও প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ভয় একটি
মনঃস্তাত্বিক জিনিস। কিন্তু শরীরের ওপর এর প্রভাব যখন পড়ে গায়ের লোমগুলো
খাড়া হয়ে যায় এবং দেহ থর থর করে কাঁপতে থাকে। আসলে যাদু প্রকৃত সত্ত্বায়
কোন পরিবর্তন ঘটায় না। তবে মানুষের মন ও তার ইন্দ্রিয়গুলো এর দ্বারা
প্রভাবিত হয়ে মনে করতে থাকে, বুঝি প্রকৃত সত্ত্বার পরিবর্তন হয়েছে। হযরত
মূসার (আঃ) দিকে যাদুকররা যেসব লাঠি ও রশি ছুঁড়ে ফেলেছিল সেগুলো সত্যি সাপে
পরিণত হয়নি। কিন্তু হাজার হাজার লোকের চোখে এমন যাদুর প্রভাব পড়লো যে,
তারা সবাই এগুলোকে সাপ মনে করলো। এমন কি হযরত মূসার (আঃ) ইন্দ্রিয়ানুভূতিও এ
যাদুর প্রভাব মুক্ত থাকতে পারেনি। অনুরূপভাবে কুরআনের সূরা আল বাকারার ১০২
আয়াতে বলা হয়েছেঃ বেবিলনে হারুত ও মারুতের কাছে লোকেরা এমন যাদু শিখতো যা
স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতো। এটা ছিল একটি
মনঃস্তাত্বিক প্রভাব। আর তাছাড়া অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লোকেরা যদি এ কাজে সফলতা
না পেতো তাহলে তারা এর খরিদ্দার হতো না। একথা ঠিক, বন্দুকের গুলী ও বোমারু
বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বোমার মতো যাদুর প্রভাবশালী হওয়াও আল্লাহ্র হুকুম
ছাড়া সম্ভবপর নয়। কিন্তু হাজার হাজার বছর থেকে যে জিনিসটি মানুষের অভিজ্ঞতা
ও পর্যবেক্ষণে ধরা দিচ্ছে তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা নিছক একটি হঠকারিতা
ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইসলামে ঝাড়-ফুঁকের স্থান
এ সূরা দু’টির ব্যাপারে তৃতীয় যে প্রশ্নটি দেখা দেয়, সেটি হচ্ছে এই যে,
ইসলামে কি ঝাড়-ফুঁকের কোন অবকাশ আছে? তাছাড়া ঝাড়-ফুঁক যথার্থই কোন প্রভাব
ফেলে কি না? এ প্রশ্ন দেখা দেবার কারণ হচ্ছে, বিপুল সংখ্যক সহীহ হাদীসে
উল্লেখিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ প্রতি রাতে ঘুমাবার আগে বিশেষ করে অসুস্থ
অবস্থায় সূরা আল ফালাক ও আন নাস এবং কোন কোন হাদীস অনুযায়ী এ দু’টির সাথে
আবার সূরা ইখলাসও তিন তিন বার করে পড়ে নিজের দুই হাতের তালুতে ফুঁক দিয়ে
মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেখানে যেখানে তাঁর হাত যেতে পারে--- সব জায়গায় হাত
বুলাতেন। শেষ বারে রোগে আক্রান্ত হবার পর যখন তাঁর নিজের পক্ষে এমনটি করা
সম্ভবপর ছিল না তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) এ সূরাগুলো (স্বেচ্ছাকৃতভাবে বা নবী
করীমের ﷺ হুকুমে) পড়তেন এবং তাঁর (নবী ﷺ) মুবারক হাতের বরকতের কথা চিন্তা
করে তাঁরই হাত নিয়ে তাঁর শরীরে বুলাতেন। এ বিষয়বস্তু সম্বলিত রেওয়ায়াত
নির্ভুল সূত্রে বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ ও মুআত্তা
ইমাম মালিকে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। আর রসূলের ﷺ পারিবারিক
জীবন সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রাঃ) ---এর চাইতে আর কারো বেশী জানার কথা নয়।
এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম শরীয়াতের দৃষ্টিভঙ্গিটি ভালোভাবে বুঝে নেয়া উচিত।
বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর একটি সুদীর্ঘ
রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। তার শেষের দিকে নবী করীম ﷺ বলেছেনঃ আমার উম্মাতের
মধ্যে তারা বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে যারা না দাগ দেয়ার চিকিৎসা
করে, না ঝাড়-ফুঁক করায় আর না শুভাশুভ লক্ষণ গ্রহন করে। (মুসলিম) হযরত
মুগীরা ইবনে শোবার (রাঃ) বর্ণনা মতে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দাগ
দেয়ার চিকিৎসা করালো এবং ঝাড়-ফুঁক করালো সে আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল থেকে
নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলো (তিরমিযী)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা
করেছেনঃ রসূলুল্লাহ ﷺ দু’টি জিনিস অপছন্দ করতেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে
ঝাড়-ফুঁক করা, তবে সূরা আল ফালাক ও আন নাস অথবা এ দু’টি ও সূরা ইখলাস ছাড়া
(আবু দাউদ, আহমাদ, নাসাঈ, ইবনে হিব্বান ও হাকেম)। কোন কোন হাদীস থেকে একথাও
জানা যায় যে, প্রথম দিকে নবী করীম ﷺ ঝাড়-ফুঁক করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ
করেছিলেন, কিন্তু পরে শর্ত সাপেক্ষে এর অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই শর্তগুলো
হচ্ছেঃ এতে কোন শিরকের আমেজ থাকতে পারবে না। আল্লাহর পবিত্র নাম বা তাঁর
পবিত্র কালামের সাহায্যে ঝাড়-ফুঁক করতে হবে। কালাম বোধগম্য হতে হবে এবং
তাঁর মধ্যে কোন গুনাহর জিনিস নেই একথা জানা সম্ভব হতে হবে। আর এই সঙ্গে
ভরসা ঝাড়-ফুঁকের ওপর করা যাবে না এবং তাকে রোগ নিরাময়কারী মনে করা যাবে না।
এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে এ মর্মে যে, আল্লাহ চাইলে এ ঝাড়-ফুঁকের
মাধ্যমেই সে রোগ নিরাময় করবেন। এ ব্যাপারে শরীয়াতের দৃষ্টিভঙ্গী সুস্পষ্ট
হয়ে যাবার পর এখন হাদীসের বক্তব্য দেখুন।
তাবারানী ‘সগীর’ গ্রন্থে হযরত আলীর (রাঃ) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা
হয়েছেঃ একবার নামায পড়ার সময় রসূলে করীমকে ﷺ বিচ্ছু কামড় দেয়। নামায শেষ
করে তিনি বলেন, বিচ্ছুর ওপর আল্লাহর লানত, সে না কোন নামাযীকে রেহাই দেয়,
না আর কাউকে। তারপর পানি ও লবণ আনান। যে জায়গায় বিচ্ছু কামড়েছিল যেখানে
নোনতা পানি দিয়ে ডলতে থাকেন আর কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন, কুল হু ওয়াল্লাহু
আহাদ, কুল আউযু বিরব্বিল ফালাক ও কুল আউযু বিরব্বিন নাস পড়তে থাকেন।
ইবনে আব্বাসের (রাঃ) বর্ণনা হাদীসে এসেছে। নবী ﷺ হযরত হাসান ও হযরত হুসাইনের ওপর এ দোয়া পড়তেনঃ
আরবী--------------------------------
“আমি তোমাদের দু’জনকে প্রত্যেক শয়তান ও কষ্টদায়ক এবং বদনজর থেকে আল্লাহর
ত্রুটিমুক্ত কালেমাসমূহের আশ্রয়ে দিয়ে দিচ্ছি।” (বুখারী, মুসনাদে আহমাদ,
তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
উসমান ইবনে আবিল আস সাকাফী সম্পর্কে সামান্য শব্দের হেরফের সহকারে মুসলিম,
মুআত্তা, তাবারানী, হাকেমে একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে তাতে বলা হয়েছেঃ
তিনি রসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে নালিশ করেন, আমি যখন থেকে মুসলমান হয়েছি তখন
থেকেই একটা ব্যথা অনুভব করছি। এ ব্যথা আমাকে মেরে ফেলে দিয়েছে। নবী ﷺ বলেন,
যেখানে ব্যথা হচ্ছে সেখানে তোমার ডান হাতটা রাখো। তারপর তিনবার বিসমিল্লাহ
পড়ো এবং সাতবার এ দোয়াটা পড়ে সেখানে হাত বুলাও
(আরবী---------------------------------------------------) “আমি আল্লাহ ও
তাঁর কুদরতের আশ্রয় চাচ্ছি সেই জিনিসের অনিষ্টকারিতা থেকে যাকে আমি অনুভব
করছি এবং যার লেগে যাওয়ার ভয়ে আমি ভীত।” মুআত্তায় এর ওপর আরো এতটুকু বৃদ্ধি
করা হয়েছে যে উসমান ইবনে আবিল আস বলেন, এরপর আমার সে ব্যথা দূর হয়ে যেতে
থাকে এবং আমার ঘরের লোকদেরকেও আমি এটা শিখাই।
মুসনাদে আহমাদ ও তাহাবী গ্রন্থে তালাক ইবনে আলীর (রাঃ) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত
হয়েছে। তাতে তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ এর উপস্থিতিতেই আমাকে বিচ্ছু কামড়
দেয়। তিনি কিছু পড়ে আমাকে ফুঁক দেন এবং কামড়ানো জায়গায় হাত বুলান। মুসলিমে
আবু সাঈদ খুদরীর (রাঃ) বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ একবার নবী ﷺ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
জিব্রীল এসে জিজ্ঞেস করেন, “হে মুহাম্মাদ! আপনি কি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? ”
জবাব দেন হ্যাঁ, জিব্রীল (আঃ) বলেন,
আরবী-------------------------
“আমি আল্লাহ্র নামে আপনাকে ঝাড়ছি এমন প্রত্যেকটি জিনিস থেকে যা আপনাকে
কষ্ট দেয় এবং প্রত্যেকটি নফ্স ও হিংসুকের হিংসা দৃষ্টির অনিষ্ট থেকে।
আল্লাহ আপনাকে নিরাময় দান করুন। আমি তাঁর নামে আপনাকে ঝাড়ছি।”
প্রায় এ একই ধরনের আর একটি বর্ণনা মুসনাদে আহমাদে হযরত উবাদা ইবনে সামেত
থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছেঃ নবী করীম ﷺ অসুস্থ ছিলেন। আমি তাঁকে
দেখতে গেলাম। দেখলাম তাঁর বেশ কষ্ট হচ্ছে। বিকেলে দেখতে গেলাম, দেখলাম তিনি
সম্পূর্ণ সুস্থ। কিভাবে এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেছেন তা জিজ্ঞেস করায়
তিনি বললেন, জিব্রীল (আঃ) এসেছিলেন এবং কিছু কালেমা পড়ে আমাকে ঝাড়-ফুঁক
করেছিলেন (তাতেই আমি সুস্থ হয়ে উঠেছি)। তারপর তিনি প্রায় ওপরের হাদীসে
উদ্ধৃত কালেমাগুলোর মতো কিছু কালেমা শুনালেন। মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদে হযরত
আয়েশা (রাঃ) থেকেও এমনি ধরনের রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম আহমাদ তাঁর
মুসনাদে উম্মূল মুমেনীন হযরত হাফসার (রাঃ) বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাতে হযরত
হাফসা (রাঃ) বলেনঃ একদিন নবী ﷺ আমার কাছে এলেন। তখন আমার কাছে শিফা *
নামের এক মহিলা বসেছিলেন।
* ভদ্র মহিলার আসল নাম ছিল লাইলা। কিন্তু তিনি শিফা বিনতে আবদুল্লাহ নামে
পরিচিত ছিলেন। হিজরতের আগে মুসলমান হন। তাঁর সম্পর্ক ছিল কুরাঈশদের বনি আদী
বংশের সাথে। হযরত উমরও (রাঃ) এ বংশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এভাবে তিনি ছিলেন
হযরত হাফসার (রাঃ) আত্মীয়া।
তিনি পিঁপড়া বা মাছি প্রভৃতির দংশনে ঝাড়-ফুঁক করতেন। রসূলে করীম ﷺ বললেনঃ
হাফসাকেও এ আমল শিখিয়ে দাও। শিফা বিনতে আবদুল্লাহর এ সংক্রান্ত একটি
রেওয়ায়াত ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ ও নাসাঈ উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, নবী ﷺ
আমাকে বললেন, তুমি হাফসাকে যেমন লেখাপড়া শিখিয়েছো তেমনিভাবে এ ঝাড়-ফুঁকের
আমলও শিখিয়ে দাও।
মুসলিমে আউফ ইবনে মালেক আশজায়ীর রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে তিনি বলেছেনঃ
জাহেলিয়াতের যুগে আমরা ঝাড়-ফুঁক করতাম। আমরা রসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস
করলাম, এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? তিনি বললেন, তোমরা যে জিনিস দিয়ে
ঝাড়-ফুঁক করো তা আমার সামনে পেশ করো। তার মধ্যে যদি শিরক না থাকে তাহলে তার
সাহায্যে ঝাড়ায় কোন ক্ষতি নেই।
মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে মাজায় হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর (রা)
রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে রসূলুল্লাহ ﷺ ঝাড়-ফুঁক নিষেধ করে
দিয়েছিলেন। তারপর হযরত আমর ইবনে হাযমের বংশের লোকেরা এলো। তারা বললো,
আমাদের কাছে এমন কিছু আমল ছিল যার সাহায্যে আমরা বিচ্ছু (বা সাপ) কামড়ানো
রোগীকে ঝাড়তাম, কিন্তু আপনি তা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তারপর তারা যা পড়তো তা
তাঁকে শুনালো । তিনি বললেন, “এর মধ্যে তো আমি কোন ক্ষতি দেখছি না। তোমাদের
কেউ যদি তার ভাইয়ের কোন উপকার করতে পারে তাহলে তাকে অবশ্যি তা করা উচিত।”
জাবের ইবনে আবদুল্লাহর (রাঃ) দ্বিতীয় হাদীসটি মুসলিমে উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে
বলা হয়েছেঃ হাযম পরিবারের লোকেরা সাপে কামড়ানো রোগীর নিরাময়ের একটা
প্রক্রিয়া জানতো। রসূলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে তা প্রয়োগ করার অনুমতি দেন। মুসলিম,
মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে মাজায় হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত রেওয়ায়াতটিও একথা
সমর্থন করে। তাতে বলা হয়েছেঃ রসূলুল্লাহ ﷺ আনসারদের একটি পরিবারকে প্রত্যেক
বিষাক্ত প্রাণীর কামড়ে ঝাড়-ফুঁক করার অনুমতি দিয়েছিলেন। মুসনাদে আহমাদ,
তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও মুসলিমেও হযরত আনাস (রাঃ) থেকে প্রায় এ একই ধরনের
একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ ﷺ বিষাক্ত
প্রাণীদের কামড়, পিঁপড়ার দংশন ও নজর লাগার জন্য ঝাড়-ফুঁক করার অনুমতি
দিয়েছিলেন।
মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও হাকেম হযরত উমাইর মাওলা আবীল লাহাম
(রাঃ) থেকে একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি বলেন, জাহেলী যুগে আমি
একটি আমল জানতাম। তার সাহায্যে আমি ঝাড়-ফুঁক করতাম। আমি রসূলুল্লাহ ﷺ এর
সামনে তা পেশ করলাম। তিনি বললেন, অমুক অমুক জিনিস এ থেকে বের করে দাও, এরপর
যা থাকে তার সাহায্যে তুমি ঝাড়তে পারো।
মুআত্তায় বলা হয়েছে হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর মেয়ে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর ঘরে
গেলেন। দেখলেন তিনি অসুস্থ এবং একটি ইহুদী মেয়ে তাঁকে ঝাড়-ফুঁক করছে। এ
দৃশ্য দেখে তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাব পড়ে ঝাড়ো। এ থেকে জানা গেলো, আহলি
কিতাবরা যদি তাওরাত বা ইঞ্জিলের আয়াত পড়ে ঝাড়-ফুঁক করে তাহলে তা জায়েয। এখন
ঝাড়-ফুঁক উপকারী কি না এ প্রশ্ন দেখা দেয়। এর জবাবে বলা যায়, রসূলুল্লাহ ﷺ
চিকিৎসা ও ঔষধ ব্যবহার করতে কখনো নিষেধ করেননি। বরং তিনি বলেছেন, আল্লাহ
প্রত্যেক রোগের ঔষধ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তোমরা রোগ নিরাময়ের জন্য ঔষধ
ব্যবহার করো। রসূল ﷺ নিজেও লোকদেরকে কোন কোন রোগের ঔষধ বলে দিয়েছেন। হাদীস
গ্রন্থসমূহে সংকলিত ‘কিতাবুত তিব’ (চিকিৎসা অধ্যায়) পাঠ করলে একথা জানা
যেতে পারে। কিন্তু ঔষধও আল্লাহর হুকুম ও অনুমতিক্রমেই উপকারী হতে পারে।
নয়তো ঔষধ ও চিকিৎসা যদি সব অবস্থায় উপকারী হতো তাহলে হাসপাতালে একটি রুগীও
মরতো না। এখন চিকিৎসা ও ঔষধের সাথে সাথে যদি আল্লাহর কালাম ও তাঁর আসমায়ে
হুসনা (ভালো ভালো নাম) থেকে ফায়দা হাসিল করা যায় অথবা যেসব জায়গায় চিকিৎসার
কোন সুযোগ-সুবিধা নেই সেখানে যদি আল্লাহর কালামের আশ্রয় গ্রহণ করে তাঁর
পবিত্র নাম ও গুণাবলীর সহায়তা লাভ করা হয় তাহলে এ পদক্ষেপ একমাত্র
বস্তুবাদীরা ছাড়া আর কারো কাছে বিবেক বিরোধী মনে হবে না।* তবে যেখানে
চিকিৎসা ও ঔষধ ব্যবহার করার সুযোগ-সুবিধা লাভ করা সম্ভব হয় সেখানে জেনে
বুঝেও তা গ্রহণ না করে শুধুমাত্র ঝাড়-ফুঁকের ওপর নির্ভর করা কোনক্রমেই সঠিক
পদক্ষেপ বলে স্বীকৃতি পেতে পারে না। আর এভাবে একদল লোককে মাদুলি তাবীজের
দোকান খুলে সুযোগ মতো দু’পয়সা কামাই করার অনুমতিও কোনক্রমেই দেয়া যেতে পারে
না।
* বস্তুবাদী দুনিয়ার অনেক ডাক্তারও একথা স্বীকার করেছেন যে, দোয়া ও আল্লাহর
প্রতি একনিষ্ঠ মানসিক সংযোগ রোগীদের রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর
উপাদান। আমার নিজের জীবনেও আমি এ ব্যাপারে দু’বার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লাভ
করেছি। ১৯৪৮ সালে কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় আমার মূত্রনালিতে একটি
পাথর সৃষ্টি হয়। ষোল ঘন্টা পর্যন্ত পেশাব আটকে থাকে। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া
করি, হে আল্লাহ! আমি জালেমদের কাছে চিকিৎসার জন্য আবেদন করতে চাই না।
তুমিই আমার চিকিৎসা করো। কাজেই পেশাবের রাস্তা থেকে পাথরটি সরে যায় এবং
পরবর্তী বিশ বছর পর্যন্ত সরে থাকে। তারপর ১৯৬৮ সালে সেটি আবার কষ্ট দিতে
থাকে। তখন অপারেশন করে তাকে বের করে ফেলা হয়। আর একবার ১৯৫৩ সালে আমাকে
গ্রেফতার করা হয়। সে সময় আমি কয়েক মাস থেকে দু’পায়ের গোছায় দাদে আক্রান্ত
হয়ে ভীষণ কষ্ট পেতে থাকি। কোন রকম চিকিৎসায় আরাম পাচ্ছিলাম না। গ্রেফতারীর
পর আল্লাহর কাছে ১৯৪৮ সালের মতো আবার সেই একই দোয়া করি। এরপর কোন প্রকার
চিকিৎসা ও ঔষধ ছাড়াই সমস্ত দাদ একেবারে নির্মূল হয়ে যায়। তারপর আর কখনো এ
রোগে আক্রান্ত হইনি।
এ ব্যাপারে অনেকে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীস থেকে যুক্তি
প্রদর্শন করে থাকেন। হাদীসটি বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, আবু
দাউদ ও ইবনে মাজায় উদ্ধৃত হয়েছে। বুখারীতে উদ্ধৃত ইবনে আব্বাসের (রাঃ)
একটি বর্ণনাও এর সমর্থন করে। এতে বলা হয়েছেঃ রসূলে করীম ﷺ কয়েকজন সাহাবীকে
একটি অভিযানে পাঠান। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) তাদের সাথে ছিলেন। তারা পথে
একটি আরব গোত্রের পল্লীতে অবস্থান করেন। তারা গোত্রের লোকদের কাছে তাদের
মেহমানদারী করার আবেদন জানান। কিন্তু তারা অস্বীকার করে। এ সময় গোত্রের
সরদারকে বিচ্ছু কামড় দেয়। লোকেরা এ মুসাফির দলের কাছে এসে আবেদন জানায়,
তোমাদের কোন ঔষধ বা আমল জানা থাকলে আমাদের সরদারের চিকিৎসা করো। হযরত আবু
সাঈদ বলেন, আমরা জানি ঠিকই, তবে যেহেতু তোমরা আমাদের মেহমানদারী করতে
অস্বীকার করেছো, তাই আমাদের কিছু দেবার ওয়াদা না করলে আমরা চিকিৎসা করবো
না। তারা একটি ছাগলের পাল (কোন কোন বর্ণনা মতে ৩০ টি ছাগল) দেবার ওয়াদা
করে। ফলে আবু সাঈদ সরদারের কাছে যান। তার ওপর সূরা ফাতেহা পড়ে ফুঁক দিতে
থাকেন এবং যে জায়গায় বিচ্ছু কামড়েছে সেখানে নিজের মুখের লালা মলতে থাকেন।*
অবশেষে বিষের প্রভাব খতম হয়ে যায়। গোত্রের লোকেরা তাদের ওয়াদা মতো ছাগল
দিয়ে দেয়। কিন্তু সাহাবীগণ নিজেদের মধ্যে বলতে থাকেন, রসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে
জিজ্ঞেস না করে এ ছাগলগুলো থেকে কোন ফায়দা হাসিল করা যাবে না। কারণ, এ
কাজে কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয কিনা তাতো জানা নেই। কাজেই তাঁরা নবী
করীমের ﷺ কাছে আসেন এবং সব ঘটনা বয়ান করেন। তিনি হেসে বলেন, তোমরা কেমন করে
জানলে এ সূরা ঝাড়-ফুঁকের কাজেও লাগতে পারে? ছাগল নিয়ে নাও, তাতে আমার ভাগও
রাখো।
*হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) যে এ আমলটি করেছিলেন এ ব্যাপারে অধিংকাশ হাদীসে
সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। এমন কি হযরত আবু সাঈদ নিজে এ অভিযানে শরীক ছিলেন কি
না একথাও সেখানে সুস্পষ্ট নয়। কিন্তু তিরমিযী বর্ণিত হাদীসে এ দু’টি কথাই
সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
কিন্তু তিরমিযী বর্ণিত এ হাদীস থেকে মাদুলি, তাবীজ ও ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে
রীতিমতো চিকিৎসা করার জন্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান কায়েম করার অনুমতি প্রমাণ
করার আগে তদানীন্তন আরবের অবস্থাও সামনে রাখতে হবে। তৎকালীন আরবের এ
অবস্থার চাপেই হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) এ কাজ করেছিলেন। রসুলে করীমও ﷺ
একে শুধু জায়েযই ঘোষণা করেননি বরং এতে নিজের অংশ রাখার হুকুমও দিয়েছিলেন,
যাতে তার জায়েয ও নাজায়েয হবার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট লোকদের মনে কোন প্রকার
সন্দেহের অবকাশ না থাকে। আসল ব্যাপার হচ্ছে, আরবের অবস্থা সেকালে যেমনটি
ছিল আজকেও তেমনটি রয়ে গেছে। পঞ্চাশ, একশো, দেড়শো মাইল চলার পরও একটি জনবসতি
চোখে পড়ে না। জনবসতিগুলোও ছিল ভিন্ন ধরনের। সেখানে কোন হোটেল, সরাইখানা বা
দোকান ছিল না। মুসাফিররা এক জনবসতি থেকে রওয়ানা হয়ে কয়েকদিন পরিশ্রম করে
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অন্য বসতিতে পৌঁছে যে খাবার-দাবার কিনে ক্ষুধা নিবারণ
করতে পারবে, এ ধরনের কোন ব্যবস্থাও সেকালে ছিল না। এ অবস্থায় আরবের প্রচলিত
রীতি ছিল, মুসাফিররা এক জনবসতি থেকে আর এক জনবসতিতে পৌঁছলে সেখানকার
লোকেরাই তাদের মেহমানদারী করতো। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের মেহমানদারী করতে
অস্বীকৃতি জানালে মুসাফিরদের মৃত্যু অবধারিত হয়ে উঠতো। কাজেই এ ধরনের
কার্যকলাপ আরবে অত্যন্ত নিন্দনীয় মনে করা হতো। এ কারণে রসূলুল্লাহ ﷺ নিজের
সাহাবীগণের এহেন কার্যকলাপকে বৈধ গণ্য করেন। গোত্রের লোকেরা যখন মুসাফিরদের
মেহমানদারী করতে অস্বীকৃতি জানায় তখন তাদের সরদারের চিকিৎসা করতেও তারা
অস্বীকার করেন এবং পরে বিনিময়ে কিছু দেয়ার শর্তে তার চিকিৎসা করতে রাজী হন।
তারপর তাদের একজন আল্লাহর ওপর ভরসা করে সূরা ফাতেহা পড়েন এবং সরদারকে
ঝাড়-ফুঁক করেন। এর ফলে সরদার সুস্থ হয়ে ওঠে। ফলে গোত্রের লোকেরা চুক্তি
মোতাবেক পারিশ্রমিক এনে তাদের সামনে হাযির করে। রসূলুল্লাহ ﷺ এ পারিশ্রমিক
গ্রহণ করা হালাল গণ্য করেন।
বুখারী শরীফে এ ঘটনা সম্পর্কিত হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রাঃ) যে
রেওয়ায়াত আছে তাতে রসূলে করীমের ﷺ বক্তব্যে বলা হয়েছেঃ আরবী------------
“তোমরা অন্য কোন আমল না করে আল্লাহর কিতাব পড়ে পারিশ্রমিক নিয়েছো, এটা
তোমাদের জন্য বেশী ন্যায়সঙ্গত হয়েছে।” তাঁর একথা বলার কারণ হচ্ছে, অন্যান্য
সমস্ত আমলের তুলনায় আল্লাহর কালাম শ্রেষ্ঠ। তাছাড়া এভাবে আরবের সংশ্লিষ্ট
গোত্রটির ওপর ইসলাম প্রচারের হকও আদায় হয়ে যায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী ﷺ যে
কালাম এনেছেন তার বরকত তারা জানতে পারে। যারা শহরে ও গ্রামে বসে
ঝাড়-ফুঁকের কারবার চালায় এবং একে নিজেদের অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে পরিণত করে
তাদের জন্য এ ঘটনাটিকে নজীর বলে গণ্য করা যেতে পারে না। নবী করীম ﷺ ,
সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও প্রথম যুগের ইমামগণের মধ্যে এর কোন নজীর পাওয়া
যায় না।
সূরা ফাতিহার সাথে এ সূরা দু’টির সম্পর্ক
সূরা আল ফালাক ও সূরা আন নাস সম্পর্কে সর্বশেষ বিবেচ্য বিষয়টি হচ্ছে, এ
সূরা দু’টির সাথে কুরআনের প্রথম সূরা আল ফাতেহার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কুরআন
মজীদ যেভাবে নাযিল হয়েছে, লিপিবদ্ধ করার সময় নাযিলের সেই ধারাবাহিকতার
অনুসরণ করা হয়নি। তেইশ বছর সময়-কালে বিভিন্ন পরিবেশ, পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের
প্রেক্ষিতে এর আয়াত ও সূরাগুলো নাযিল হয়েছে। বর্তমানে আমরা কুরআনকে যে
আকৃতিতে দেখছি, রসূলুল্লাহ ﷺ স্বেচ্ছাকৃতভাবে তাকে এ আকৃতি দান করেননি বরং
কুরআন নাযিলকারী আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী এ আকারে তাকে বিন্যস্ত করেছেন। এ
বিন্যাস অনুযায়ী সূচনা হয় সূরা ফাতেহা থেকে এবং সমাপ্তি হয় আল ফালাক ও আন
নাসে এসে। এখন উভয়ের ওপর একবার দৃষ্টি বুলালে দেখা যাবে, শুরুতে রব্বুল
আলামীন, রহ্মানুর রহীম ও শেষ বিচার দিনের মালিক আল্লাহ্র প্রশংসা বাণী
উচ্চারণ করে বান্দা নিবেদন করছে, আমি তোমারই বন্দেগী করি তোমারই কাছে
সাহায্য চাই এবং তোমার কাছে আমি যে সবচেয়ে বড় সাহায্যটা চাই সেটি হচ্ছে এই
যে আমাকে সহজ-সরল-সত্য পথটি দেখিয়ে দাও। জবাবে সোজা পথ দেখাবার জন্য
আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে পুরো কুরআন মজীদটি নাযিল করা হয়। একে এমন একটি
বক্তব্যের ভিত্তিতে শেষ করা হয় যখন বান্দা সকাল বেলার রব, মানবজাতির বর,
মানবজাতির বাদশাহ ও মানবজাতির ইলাহ্ মহান আল্লাহ্র কাছে এ মর্মে আবেদন
জানায় যে, সে প্রত্যেক সৃষ্টির প্রত্যেকটি ফিতনা ও অনিষ্টকারিতা থেকে
সংরক্ষিত থাকার জন্য একমাত্র তাঁরই কাছে আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে জিন ও
মানবজাতির অন্তর্ভুক্ত শয়তানদের প্ররোচনা থেকে সে একমাত্র তাঁরই আশ্রয় চায়।
কারণ, সঠিক পথে চালার ক্ষেত্রে সে-ই হয় সবচেয়ে বড় বাধা। কাজেই দেখা
যাচ্ছে, সূরা ফাতিহার সূচনার সাথে এই শেষ দুই সূরার যে সম্পর্ক, তা কোন
গভীর দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তির আগোচরে থাকার কথা নয়।
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন