নূহ-71
|
১.)
আমি নূহকে তাঁর জাতির কাছে পাঠিয়েছিলাম (এ নির্দেশ দিয়ে) যে, একটি কষ্টদায়ক আযাব আসার আগেই তুমি তাদেরকে সাবধান করে দাও।১
|
|
২.)
সে বললো, হে আমার জাতি, আমি তোমাদের জন্য একজন সতর্ককারী
|
|
৩.)
(বার্তাবাহক, আমি তোমাদের জানিয়ে দিচ্ছি) যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো, তাঁকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো,২
|
|
|
৫.)
সে৭ বললোঃ হে আমার বর, আমি আমার কওমের লোকদের রাত-দিন আহবান করেছি।
|
|
৬.)
কিন্তু আমার আহবান তাদের দূরে সরে যাওয়াকে কেবল বাড়িয়েই তুলেছে। ৮
|
|
|
৮.)
অতঃপর আমি তাদেরকে উচ্চকণ্ঠে আহবান জানিয়েছি।
|
|
৯.)
তারপর প্রকাশ্যে তাদের কাছে তাবলীগ করেছি এবং গোপনে চুপে চুপে বুঝিয়েছি।
|
|
১০.)
আমি বলেছি তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাও। নিঃসন্দেহে তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল।
|
|
১১.)
তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষাবেন।
|
|
১২.)
সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন আর নদী-নালা প্রবাহিত করে দিবেন।১২
|
|
১৩.)
তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে বলে মনে করছো না।১৩
|
|
১৪.)
অথচ তিনিই তোমাদের পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন।১৪
|
|
১৫.)
তোমরা কি দেখো না, আল্লাহ কিভাবে সাত স্তরে বিন্যস্ত করে আসমান সৃষ্টি করেছেন?
|
|
১৬.)
ওগুলোর মধ্যে চাঁদকে আলো এবং সূর্যকে প্রদীপ হিসেবে স্থাপন করেছেন।
|
|
১৭.)
আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে মাটি থেকে বিস্ময়কররূপে উৎপন্ন করেছেন।১৫
|
|
১৮.)
আবার এ মাটির মধ্যে তোমাদের ফিরিয়ে নেবেন এবং অকস্মাৎ এ মাটি থেকেই তোমাদের বের করে আনবেন।
|
|
১৯.)
আল্লাহ ভূপৃষ্ঠকে তোমাদের জন্য বিছানার মত করে পেতে দিয়েছেন।
|
|
২০.)
যেন তোমরা এর প্রশস্ত পথে চলতে পারো
|
|
২১.)
নূহ বললোঃ হে প্রভু, তারা আমার কথা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ঐসব নেতার
অনুসরণ করেছে যারা সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পেয়ে আরো বেশী ব্যর্থ হয়ে
গিয়েছে।
|
|
২২.)
এসব লোক সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র-জাল বিস্তার করে রেখেছে।১৬
|
|
২৩.)
তারা বলেছে, তোমরা নিজেদের দেব-দেবীদের কোন অবস্থায় পরিত্যাগ করো না। আর ওয়াদ, সুওয়া’আ, ইয়াগুস, ইয়াউক এবং নাসরকেও১৭ পরিত্যাগ করো না।
|
|
২৪.)
অথচ এসব দেব-দেবী বহু লোককে গোমরাহীতে নিক্ষেপ করেছে। তুমিও এসব জালেমদের জন্য গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না।১৮
|
|
|
২৬.)
আর নূহ বললোঃ হে আমার রব, এ কাফেরদের কাউকে পৃথিবীর বুকে বসবাসের জন্য রেখো না।
|
|
২৭.)
তুমি যদি এদের ছেড়ে দাও তাহলে এরা তোমার বান্দাদের বিভ্রান্ত করবে এবং
এদের বংশে যারাই জন্মলাভ করবে তারাই হবে দুষ্কৃতকারী ও কাফের।
|
|
২৮.)
হে আমার রব, আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যারা মু’মিন হিসেবে আমার ঘরে প্রবেশ
করেছে তাদেরকে এবং সব মু’মিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করে দাও। জালেমদের জন্য
ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না।
|
নামকরণ
‘নূহ’ এ সূরার নাম। এর বিষয়বস্তুর শিরোনামও ‘নূহ’। কারণ এতে প্রথম থেকে
শেষ পর্যন্ত হযরত ‘নূহ’ আলাইহিস সালামের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
নাযিল হওয়ার সময়-কাল
এটিও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনের প্রাথমিক
পর্যায়ে নাযিল হওয়া সূরাসমূহের অন্যতম। তবে এর বিষয়বস্তুর আভ্যন্তরীণ
সাক্ষ্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যে সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের দাওয়াত ও তাবলীগের বিরুদ্ধে মক্কার কাফেরদের শত্রুতামূলক
আচরণ বেশ তীব্রতা লাভ করেছিল তখন এ সূরাটি নাযিল হয়েছিল।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
এতে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তবে তা কেবল কাহিনী
বর্ণনার উদ্দেশ্যে করা হয়নি।বরং এর উদ্দেশ্য মক্কার কাফেরদের এ মর্মে
সাবধান করা যে, হযরত নূহ আলাইহিস সালামের সাথে তার কওম যে আচরণ করেছিল
তোমরাও হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সে একই
আচরণ করছো। তোমরা যদি এ আচরণ থেকে বিরত না হও তাহলে তোমাদেরও সে একই
পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে যার সম্মুখীন হয়েছিল ঐসব লোকেরা। গোটা সূরার
মধ্যে একথাটি স্পষ্ট ভাষায় কোথাও বলা হয়নি। কিন্তু যে অবস্থা ও
পরিস্থিতিতে মক্কীবাসীদের এ কাহিনী শুনানো হয়েছে তার পটভূমিতে এ বিষয়টি
আপনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যে সময় আল্লাহ তা’আলা হযরত নূহ আলাইহিস সালামকে রিসালাতের পদ মর্যাদায়
অভিষিক্ত করেছিলেন সে সময় তাঁর ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন প্রথম আয়াতে
তা বলা হয়েছে।
তিনি তাঁর দাওয়াত কিভাবে শুরু করেছিলেন এবং স্বজাতির মানুষের সামনে কি বক্তব্য পেশ করেছিলেন।
২ থেকে ৪ পর্যন্ত আয়াতে তা সংক্ষিপ্তাকারে বলা হয়েছে, এরপর দীর্ঘকাল
পর্যন্ত দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগের জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট বরণ করার পর
তার যে বর্ণনা হযরত নূহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর দরবারে পেশ করেছিলেন ৫ থেকে
২০ আয়াতে তা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি তাঁর জাতিকে সত্য পথে আনার জন্য কিভাবে
চেষ্টা-সাধনা করেছেন আর তাঁর জাতির লোকেরা কি রকম হঠকারিতার মাধ্যমে তার
বিরোধিতা করেছে এ পর্যায়ে তিনি তার সবই তাঁর প্রভুর সামনে পেশ করেছেন।
এরপর ২১ থেকে ২৪ আয়াতে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের শেষ আবেদনের বিষয় উল্লেখ
করা হয়েছে। এতে তিনি মহান আল্লাহর কাছে এ মর্মে আবেদন করেছেন যে, এ জাতি
আমার দাওয়াত চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এরা তাদের নেতাদের হাতে
নিজেদের লাগাম তুলে দিয়েছে এবং বিরাট ও ব্যাপক ষড়যন্ত্র-জাল বিস্তার করেছে।
এখন তাদের থেকে হিদায়াত গ্রহণ করার শুভবুদ্ধি ও যোগ্যতা ছিনিয়ে নেয়ার সময়
এসে গেছে। হযরত নূহ আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে এটা কোন প্রকার অধৈর্যের
বহিঃপ্রকাশ ছিল না। বরং শত শত বছর ধরে ধৈর্যের চরম পরীক্ষার মত
পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে দ্বীনের তাবলীগের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার পর যে সময়
তিনি তাঁর কওমের ব্যাপারে পুরোপুরি নিরাশ হয়ে গেলেন কেবল তখনই তিনি এ
সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, এখন এ জাতির সত্য ও ন্যায়ের পথে আসার আর কোন
সম্ভাবনাই নেই। তাঁর এ সিদ্ধান্ত ছিল হুবহু আল্লাহ তা’আলার ফায়সালার
অনুরূপ। তা-ই এর পরবর্তী ২৫ আয়াতেই বলা হয়েছে। এ জাতির কৃতকর্মের কারণে
তাদের ওপর আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আযাব নাযিল হলো।
আযাব নাযিল হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে হযরত নূহ আলাইহিস সালাম আল্লাহ
তা’আলার কাছে যে দোয়া করেছিলেন শেষ আয়াতটিতে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে
তিনি নিজের ও ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং নিজ কওমের
কাফেরদের জন্য এ মর্মে আল্লাহর কাছে আবেদন করছেন যেন তাদের কাউকেই পৃথিবীর
বুকে বসবাস করার জন্য জীবিত রাখা না হয়, কারণ তাদের মধ্যে এখন আর কোন
কল্যাণই অবশিষ্ট নেই। তাই তাদের ঔরসে এখন যারাই জন্মলাভ করবে তারাই কাফের
এবং পাপী হিসেবেই বেড়ে উঠবে।
এ সূরা অধ্যয়নকালে ইতিপূর্বে কুরআন মজীদে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের কাহিনীর
যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করা হয়েছে তাও সামনে থাকা দরকার। দেখুন সূরা আল
আ’রাফ, আয়াত ৫৯ থেকে ৬৪; ইউনূস, ৭১ থেকে ৭৩; হুদ, ২৫ থেকে ৪৯; আল
মু’মিনূন, ২৩ থেকে ৩১; আশ শু’আরা, ১০৫ থেকে ১২২; আল আনকাবুত, ১৪ ও ১৫, আস
সাফফাত, ৭৫ থেকে ৮২ এবং আল কামার, ৯ থেকে ১৬ আয়াত পর্যন্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন