রবিবার, ১ মার্চ, ২০১৫

আন নাযি’আত-79

আন নাযি’আত-79 

 
১.) সেই ফেরেশতাদের কসম যারা ডুব দিয়ে টানে
 
২.) এবং খুব আস্তে আস্তে বের করে নিয়ে যায়।
 
৩.) আর (সেই ফেরেশতাদেরও যারা বিশ্বলোকে) দ্রুত গতিতে সাঁতরে চলে,
 
৪.) বারবার (হুকুম পালনের ব্যাপারে) সবেগে এগিয়ে যায়,
 
৫.) এরপর (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) সকল বিষয়ের কাজ পরিচালনা করে।
 
৬.) যেদিন ভূমিকম্পের ধাক্কা ঝাঁকুনি দেবে
 
৭.) এবং তারপর আসবে আর একটি ধাক্কা।
 
৮.) কতক হৃদয় সেদিন ভয়ে কাঁপতে থাকবে।
 
৯.) দৃষ্টি হবে তাদের ভীতি বিহবল।
 
১০.) এরা বলে, “সত্যিই কি আমাদের আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে?
 
১১.) পচা-গলা হাড্ডিতে পরিণত হয়ে যাওয়ার পরও?”
 
১২.) বলতে থাকে “তাহলে তো এ ফিরে আসা হবে বড়ই লোকসানের!”
 
১৩.) অথচ এটা শুধুমাত্র একটা বড় রকমের ধমক
 
১৪.) এবং হঠাৎ তারা হাযির হবে একটি খোলা ময়দানে।
 
১৫.) তোমার কাছে কি মূসার ঘটনার খবর পৌঁছেছে?
 
১৬.) যখন তার রব তাকে পবিত্র ‘তুওয়া’ উপত্যকায় ডেকে বলেছিলেন,
 
১৭.) “ফেরাউনের কাছে যাও, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে।
 
১৮.) তাকে বলো, তোমার কি পবিত্রতা অবলম্বন করার আগ্রহ আছে
 
১৯.) এবং তোমার রবের দিকে আমি তোমাকে পথ দেখাবো, তাহলে তোমার মধ্যে (তাঁর) ভয় জাগবে?”
 
২০.) তারপর মূসা ফেরাউনের কাছে গিয়ে তাকে বড় নিদর্শন দেখালো।
 
২১.) কিন্তু সে মিথ্যা মনে করে প্রত্যাখ্যান করলো ও অমান্য করলো,
 
২২.) তারপর চালবাজী করার মতলবে পিছন ফিরলো।১০
 
২৩.) এবং লোকদের জমায়েত করে তাদেরকে সম্বোধন করে বললোঃ
 
২৪.) “আমি তোমাদের সবচেয়ে বড় রব”১১
 
২৫.) অবশেষে আল্লাহ‌ তাকে আখেরাত ও দুনিয়ার আযাবে পাকড়াও করলেন।
 
২৬.) আসলে এর মধ্যে রয়েছে মস্তবড় শিক্ষা, যে ভয় করে তার জন্যে।১২
 
২৭.) তোমাদের ১৩ সৃষ্টি করা বেশী কঠিন কাজ, না আকাশের?১৪ আল্লাহই তাকে সৃষ্টি করেছেন,
 
২৮.) তার ছাদ অনেক উঁচু করেছেন। তারপর তার ভারসাম্য কায়েম করেছেন।
 
২৯.) তার রাতকে ঢেকে দিয়েছেন এবং তার দিনকে প্রকাশ করেছেন।১৫
 
৩০.) এরপর তিনি যমীনকে বিছিয়েছেন।১৬
 
৩১.) তার মধ্য থেকে তার পানি ও উদ্ভিদ বের করেছেন১৭
 
৩২.) এবং তার মধ্যে পাহাড় গেড়ে দিয়েছেন,
 
৩৩.) জীবন যাপনের সামগ্রী হিসেবে তোমাদের ও তোমাদের গৃহপালিত পশুদের জন্য১৮
 
৩৪.) তারপর যখন মহাবিপর্যয় ঘটবে।১৯
 
৩৫.) যেদিন মানুষ নিজে যা কিছু করেছে তা সব স্মরণ করবে২০
 
৩৬.) এবং প্রত্যেক দর্শনকারীর সামনে জাহান্নাম খুলে ধরা হবে,
 
৩৭.) তখন যে ব্যক্তি সীমালংঘন করেছিল
 
৩৮.) এবং দুনিয়ার জীবনকে বেশী ভালো মনে করে বেছে নিয়েছিল,
 
৩৯.) জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা।
 
৪০.) আর যে ব্যক্তি নিজের রবের সামনে এসে দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীত ছিল এবং নফসকে খারাপ কামনা থেকে বিরত রেখেছিল
 
৪১.) তার ঠিকানা হবে জান্নাত।২১
 
৪২.) এরা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে, সেই সময়টি (কিয়ামত) কখন আসবে?২২
 
৪৩.) সেই সময়টি বলার সাথে তোমার সম্পর্ক কি?
 
৪৪.) এর জ্ঞান তো আল্লাহ‌ পর্যন্তই শেষ।
 
৪৫.) তাঁর ভয়ে ভীত এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে সতর্ক করাই শুধুমাত্র তোমার দায়িত্ব।২৩
 
৪৬.) যেদিন এরা তা দেখে নেবে সেদিন এরা অনুভব করবে যেন (এরা দুনিয়ায় অথবা মৃত অবস্থায়) একদিন বিকালে বা সকালে অবস্থান করেছে মাত্র।২৪

নামকরণ

সূরার প্রথম শব্দ وَالنَاِزعَاتْ থেকে এ নামকরণ করা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কাল

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আম্মা ইয়াতাসা-আলূনা”র পরে এ সূরাটি নাযিল হয়। এটি যে প্রথম দিকের সূরা তা এর বিষয়বস্তু থেকেও প্রকাশ হচ্ছে।

বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয়

এ সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে কিয়ামত ও মৃত্যুর পরের জীবনের প্রমাণ এবং এ সংগে আল্লাহর রসূলকে মিথ্যা বলার পরিণাম সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ।
বক্তব্যের সূচনায় মৃত্যুকালে প্রাণ হরণকারী, আল্লাহর বিধানসমূহ দ্রুত বাস্তবায়নকারী এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সারা বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থা পরিচালনাকারী ফেরেশতাদের কসম খেয়ে নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে যে, কিয়ামত অবশ্যি হবে এবং মৃত্যুর পরে নিশ্চিতভাবে আর একটি নতুন জীবনের সূচনা হবে। কারণ যে ফেরেশতাদের সাহায্যে আজ মানুষের প্রাণবায়ু নির্গত করা হচ্ছে তাদেরই সাহায্যে আবার মানুষের দেহে প্রাণ সঞ্চার করা যেতে পারে। যে ফেরেশতারা আজ মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে সংগে সংগেই আল্লাহর হুকুম তামিল করে যাচ্ছে এবং সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালনা করছে, আগামীকাল সেই ফেরেশতারাই সেই একই আল্লাহর হুকুমে এ বিশ্ব ব্যবস্থা ওলটপালট করে দিতে এবং আর একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
এরপর লোকদের জানানো হয়েছে, এই যে কাজটিকে তোমরা একেবারেই অসম্ভব মনে করো, আল্লাহর জন্য এটি আদতে এমন কোন কঠিন কাজই নয়, যার জন্য বিরাট ধরনের কোন প্রস্তুতির প্রয়োজন হতে পারে। একবার ঝাঁকুনি দিলেই দুনিয়ার এ সমস্ত ব্যবস্থা ওলটপালট হয়ে যাবে। তারপর আর একবার ঝাঁকুনি দিলে তোমরা অকস্মাৎ নিজেদেরকে আর একটি নতুন জগতের বুকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পাবে। তখন যারা এ পরবর্তী জগতের কথা অস্বীকার করতো তারা ভয়ে কাঁপতে থাকবে। যেসব বিষয় তারা অসম্ভব মনে করতো তখন সেগুলো দেখতে থাকবে অবাক বিস্ময়ে।
তারপর সংক্ষেপে হযরত মূসা (আ) ও ফেরাউনের কথা বর্ণনা করে লোকদের সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর রসূলকে মিথ্যা বলার, তাঁর হিদায়াত ও পথনির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করার এবং প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তাঁকে পরাজিত করার জন্য প্রচেষ্ট চালাবার পরিণাম ফেরাউন দেখে নিয়েছে। ফেরাউনের পরিণাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তোমরা যদি নিজেদের কর্মনীতি পরিবর্তন না করো তাহলে তোমাদের পরিণামও অন্য রকম হবে না।
এরপর ২৭ থেকে ৩৩ আয়াত পর্যন্ত মৃত্যুর পরের জীবনের সপক্ষে যুক্তি প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই অস্বীকারকারীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তোমাদের দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা কি বেশী কঠিন কাজ অথবা প্রথমবার মহাশূন্যের অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রসহ এ বিশাল বিস্তীর্ণ বিশ্ব-জগত সৃষ্টি করা কঠিন কাজ? যে আল্লাহর জন্য এ কাজটি কঠিন ছিল না তাঁর জন্য তোমাদের দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা কঠিন হবে কেন? মাত্র একটি বাক্যে আখেরাতের সম্ভাবনার সপক্ষে এ অকাট্য যুক্তি পেশ করার পর পৃথিবীর প্রতি এবং পৃথিবীতে মানুষ ও অন্যান্য জীবের জীবন ধারণের জন্য যেসব উপকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। পৃথিবীতে জীবন ধারণের এ উপকরণের প্রতিটি বস্তুই এই মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও কর্মকুশলতা সহকারে তাকে কোন না কোন উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ইঙ্গিত করার পর মানুষের নিজের চিন্তা-ভাবনা করে মতামত গঠনের জন্য এ প্রশ্নটি তার বুদ্ধিমত্তার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে যে, সমগ্র বিশ্ব-জাহানের এ বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থায় মানুষের মতো একটি বুদ্ধিমান জীবকে স্বাধীন ক্ষমতা, ইখতিয়ার ও দায়িত্ব অর্পণ করে তার কাজের হিসেব নেয়া, অথবা সে পৃথিবীর বুকে সব রকমের কাজ করার পর মরে গিয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে এবং চিরকালের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তারপর তাকে যে খমতা-ইখতিয়ারগুলো দেয়া হয়েছিল সেগুলো সে কিভাবে ব্যবহার করেছে এবং যে দায়িত্বসমূহ তার ওপর অর্পণ করা হয়েছিল সেগুলো কিভাবে পালন করেছে, তার হিসেব কখনো নেয়া হবে না---এর মধ্যে কোনটি বেশী যুক্তিসংগত বলে মনে হয়? এ প্রশ্নে এখানে কোন আলোচনা করার পরিবর্তে ৩৪ থেকে ৪১ পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে, হাশরের দিন মানুষের স্থায়ী ও চিরন্তন ভবিষ্যতের ফায়সালা করা হবে। দুনিয়ায় নির্ধারিত সীমানা লংঘন করে কে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করেছে, পার্থিব লাভ স্বার্থ ও স্বাদ আস্বাদনকে উদ্দেশ্যে পরিণত করেছে এবং কে নিজের রবের সামনে হিসেব-নিকেশের জন্য দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীতি অনুভব করেছে ও নফসের অবৈধ আকাংখা বাসনা পূর্ণ করতে অস্বীকার করেছে, সেদিন এরই ভিত্তিতে ফায়সালা অনুষ্ঠিত হবে। একথার মধ্যেই ওপরের প্রশ্নের সঠিক জবাব রয়ে গেছে। জিদ ও হঠকারিতামুক্ত হয়ে ঈমানদারীর সাথে এ সম্পর্কে চিন্তা করলে যে কোন ব্যক্তিই এ জবাব হাসিল করতে পারে। কারণ মানুষকে দুনিয়ায় কাজ করার জন্য যেসব ইখতিয়ার ও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তার ভিত্তিতে কাজ শেষে তার কাজের হিসেব নেয়া এবং তাকে শাস্তি বা পুরস্কার দেয়াই হচ্ছে এ ইখতিয়ার ও দায়িত্বের স্বাভাবিক, নৈতিক ও যুক্তিসংগত দাবী।
সবশেষে মক্কায় কাফেরদের যে একটি প্রশ্ন ছিল ‘কিয়ামত কবে আসবে, তার জবাব দেয়া হয়েছে। এ প্রশ্নটি তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের কাছে বারবার করতো। জবাবে বলা হয়েছে, কিয়ামত কবে হবে তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। রসূলের কাজ হচ্ছে শুধূমাত্র কিয়ামত যে অবশ্যই হবে এ সম্পর্কে লোকদেরকে সতর্ক করে দেয়া। এখন যার ইচ্ছা কিয়ামতের ভয়ে নিজের কর্মনীতি সংশোধন করে নিতে পারে। আবার যার ইচ্ছা কিয়ামতের ভয়ে ভীত না হয়ে লাগামহীনভাবে চলাফেরা করতে পারে। তারপর যখন সে সময়টি এসে যাবে তখন এ দুনিয়ার জীবনের জন্য যারা প্রাণ দিতো এবং একেই সবকিছু মনে করতো, তারা অনুভব করতে থাকবে, এ দুনিয়ার বুকে তারা মাত্র সামান্য সময় অবস্থান করেছিল। তখন তারা জানতে পারবে, এ মাত্র কয়েকদিনের জীবনের বিনিময়ে তারা চিরকালের জন্য নিজেদের ভবিষ্যত কিভাবে বরবাদ করে দিয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন