আল লাহাব(111)
|
১.)
ভেঙে গেছে আবু লাহাবের হাত এবং ব্যর্থ হয়েছে সে।১
|
|
২.)
তার ধন-সম্পদ এবং যা কিছু সে উপার্জন করেছে তা তার কোন কাজে লাগেনি।২
|
|
৩.)
অবশ্যই সেই লেলিহান আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।
|
|
|
৫.)
তার গলায় থাকবে খেজুর ডালের আঁশের পাকানো শক্ত রশি।
নামকরণ
প্রথম আয়াতের লাহাব (لَهَب) শব্দকে এ সূরার নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
নাযিলের সময়-কাল
এর মক্কী হবার ব্যাপারে তাফসীরকারদের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। কিন্তু মক্কী
যুগের কোন্ সময় এটি নাযিল হয়েছিল তা যথাযথভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। তবে
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর ইসলামী দাওয়াতের
বিরুদ্ধে আবু লাহাবের যে ভূমিকা এখানে দেখা গেছে তা থেকে আন্দাজ করা যেতে
পারে যে, এ সূরাটি এমন যুগে নাযিল হয়ে থাকবে যখন রসূলের (সা.) সাথে
শত্রুতার ক্ষেত্রে সে সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল এবং তার দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মনীতি
ইসলামের অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধার সৃষ্টি করেছিল। সম্ভবত কুরাইশরা যখন
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর বংশের লোকদেরকে
সামাজিকভাবে বয়কট করে তাদের শে’বে আবু তালেবে (আবু তালেব গিরিপথ) অন্তরীণ
করেছিল এবং একমাত্র আবু লাহাবই তার বংশের লোকদেরকে পরিত্যাগ করে শত্রুদের
সাথে অবস্থান করছিল, তখনই এ সূরাটি নাযিল হওয়া বিচিত্র নয়। আমাদের এ
অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে, আবু লাহাব ছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের চাচা। আর ভাতিজার মুখে চাচার প্রকাশ্যে নিন্দাবাদ ততক্ষণ সংগত
হতে পারতো না যতক্ষণ চাচার সীমা অতিক্রমকারী অন্যায়, জুলম ও বাড়াবাড়ি
উন্মুক্তভাবে সবার সামনে না এসে গিয়ে থাকে। এর আগে যদি শুরুতেই এ সূরাটি
নাযিল করা হতো তাহলে লোকেরা নৈতিক দিক দিয়ে একে ত্রুটিপূর্ণ মনে করতো। কারণ
ভাতিজার পক্ষে এভাবে চাচার নিন্দা করা শোভা পায় না।
পটভূমি
কুরআনে মাত্র এ একটি জায়গাতেই ইসলামের শত্রুদের কারো নাম নিয়ে তার নিন্দা
করা হয়েছে। অথচ মক্কায় এবং হিজরতের পরে মদীনায়ও এমন অনেক লোক ছিল যারা
ইসলাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শত্রুতার ক্ষেত্রে
আবু লাহাবের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যক্তিটির এমনকি
বিশেষত্ব ছিল যে কারণে তার নাম নিয়ে নিন্দা করা হয়েছে? একথা বুঝার জন্য
সমকালীন আরবের সামাজিক অবস্থা অনুধাবন এবং সেখানে আবু লাহাবের ভূমিকা
পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। প্রাচীন যুগে যেহেতু সারা আরব দেশের সব জায়গায়
অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, লুটতরাজ ও রাজনৈতিক অরাজকতা বিরাজ করছিল এবং শত শত বছর
থেকে এমন অবস্থা চলছিল যার ফলে কোন ব্যক্তির জন্য তার নিজের বংশ ও রক্ত
সম্পর্কের আত্মীয়- পরিজনের সহায়তা ছাড়া নিজের ধন-প্রাণ ও ইজ্জত-আবরুর
হেফাজত করা কোনক্রমেই সম্ভবপর ছিল না। এজন্য আরবীয় সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের
মধ্যে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বের অধিকারী।
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করাকে মহাপাপ মনে করা হতো। রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এগিয়ে এলেন তখন
আরবের ঐ প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রভাবে কুরাইশ গোত্রের অন্যান্য পরিবার ও তাদের
সরদাররা তাঁর কঠোর বিরোধিতা করলেও বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিব (হাশেমের ভাই
মুত্তালিবের সন্তানরা) কেবল তাঁর বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেনি বরং প্রকাশ্যে
তাঁকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। অথচ তাদের অধিকাংশই তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান
আনেনি। কুরাইশের অন্যান্য পরিবারের লোকেরাও রসূলুল্লাহর (সা.) রক্ত
সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনদের এ সমর্থন-সহযোগিতাকে আরবের নৈতিক ঐতিহ্যের
যথার্থ অনুসারী মনে করতো। তাই তারা কখনো বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে এই
বলে ধিক্কার দেয়নি যে, তোমরা একটি ভিন্ন ধর্মের আহবায়কের প্রতি সমর্থন দিয়ে
নিজেদের পৈতৃক ধর্ম থেকে বিচ্যূত হয়ে গেছো। তারা একথা জানতো এবং স্বীকারও
করতো যে, নিজেদের পরিবারের একজন সদ্যস্যকে তারা কোনক্রমেই শক্রর হাতে তুলে
দিতে পারে না। কুরাইশ তথা সমগ্র আরবের অধিবাসীরাই নিজেদের আত্মীয়ের সাথে
সহযোগিতা করাকে একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করতো।
জাহেলী যুগেও আরবের লোকেরা এ নৈতিক আদর্শকে অত্যন্ত মর্যাদার চোখে দেখতো।
অথচ শুধুমাত্র একজন লোক ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতায় অন্ধ হয়ে এ আদর্শ
ও মূলনীতি লংঘন করে। সে ছিল আবু লাহাব ইবনে আবদুল মুত্তালিব। রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা। রসূলের (সা.) পিতা এবং এ আবু
লাহাব ছিল একই পিতার সন্তান। আরবে চাচাকে বাপের মতই মনে করা হতো। বিশেষ করে
যখন ভাতিজার বাপের ইন্তিকাল হয়ে গিয়েছিল তখন আরবীয় সমাজের রীতি অনুযায়ী
চাচার কাছে আশা করা হয়েছিল, সে ভাতিজাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসবে। কিন্তু
এ ব্যক্তি ইসলাম বৈরিতা ও কুফরী প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে এ সমস্ত আরবীয়
ঐতিহ্যকে পদদলিত করেছিল।
মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন সূত্রে ইবনে আব্বাস থেকে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন।
তাতে বলা হয়েছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বসাধারণের
কাছে দাওয়াত পেশ করার হুকুম দেয়া হলো এবং কুরআন মজীদে এ মর্মে নির্দেশ
দেয়া হলোঃ “সবার আগে আপনার নিকট আত্মীয়দেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখান।” এ
নির্দেশ পাওয়ার পর সকাল বেলা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
সাফা পাহাড়ে উঠে বুলন্দ আওয়াজে চিৎকার করে বললেন
(আরবী------------------------) (হায়, সকাল বেলার বিপদ!) আরবে এ ধরনের
আওয়াজ এমন এক ব্যক্তি দিয়ে থাকে যে ভোর বেলার আলো আঁধারীর মধ্যে কোন
শত্রুদলকে নিজেদের গোত্রের ওপর আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে দেখে থাকে।
রসূলুল্লাহর (সা.) এ আওয়াজ শুনে লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, কে আওয়াজ দিচ্ছে? বলা
হলো মুহাম্মাদ (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আওয়াজ
দিচ্ছেন। একথা শুনে কুরাইশদের সমস্ত পরিবারের লোকেরা দৌঁড়ে গেলো তাঁর দিকে ।
যে নিজে আসতে পারতো সে নিজে এসে গেলো এবং সে নিজে আসতে পারতো না সে তার
একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিল। সবাই পৌঁছে গেলে তিনি কুরাইশের প্রত্যেকটি
পরিবারের নাম নিয়ে ডেকে ডেকে বললেনঃ হে বনী হাশেম! হে বনী আবদুল মুত্তালিব!
হে বনী ফেহর! হে বনী উমুক! হে বনী উমুক! যদি আমি তোমাদের এ কথা বলি, এ
পাহাড়ের পেছনে একটি সেনাবাহিনী প্রস্তুত হয়ে রয়েছে তোমাদের ওপর আক্রমণ করার
জন্য, তাহলে আমার কথা কি তোমরা সত্য বলে মেনে নেবে? লোকেরা জবাব দিল,
হ্যাঁ, আমরা কখনো আপনার মুখে মিথ্যা কথা শুনিনি। একথা শুনে তিনি বললেনঃ
তাহলে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, আগামীতে কঠিন আযাব আসছে। একথায় অন্য
কেউ বলার আগে তাঁর নিজের চাচা আবু লাহাব বললোঃ “তোমার সর্বনাশ হোক, তুমি কি
এজন্য আমাদের ডেকেছিলে?” অন্য একটি হাদীসে একথাও বলা হয়েছে, সে রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে ছুঁড়ে মারার জন্য একটি পাথর
উঠিয়েছিল। (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে জারীর ইত্যাদি)।
ইবনে যায়েদ বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ আবু লাহাব একদিন রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, যদি আমি তোমার দ্বীন
গ্রহণ করি তাহলে এর বদলে আমি কি পাবো? তিনি জবাব দিলেন, অন্যান্য ঈমানদাররা
যা পাবে আপনিও তাই পাবেন। আবু লাহাব বললোঃ আমার জন্য কিছু বাড়তি মর্যাদা
নেই? জবাব দিলেনঃ আপনি আর কি চান? একথায় সে বললোঃ
(আরবী--------------------------) “সর্বনাশ হোক এ দ্বীনের যেখানে আমি ও
অন্যান্য লোকেরা একই পর্যায়ভুক্ত হবে।” (ইবনে জারীর)
মক্কায় আবু লাহাব ছিল রসূলুল্লাহর (সা.) নিকটতম প্রতিবেশী । উভয়ের ঘরের
মাঝখানে ছিল একটি প্রাচীর। এছাড়াও হাকাম ইবনে আস (মারওয়ানের বাপ), উকবা
উবনে আবু মুঈত, আদী ইবনে হামরা ও ইবনুল আসদায়েল হুযালীও তাঁর প্রতিবেশী
ছিল। এরা বাড়িতেও রসূলুল্লাহকে নিশ্চিন্তে থাকতে দিতো না। তিনি যখন নামায
পড়তেন, এরা তখন ওপর থেকে ছাগলের নাড়িভূড়ি তাঁর গায়ে নিক্ষেপ করতো। কখনো
তাঁর বাড়ির আঙিনায় রান্নাবান্না হতো এরা হাঁড়ির মধ্যে ময়লা ছুঁড়ে দিতো।
রসূলুল্লাহ (সা.) বাইরে এসে তাদেরকে বলতেন, “হে বনী আবদে মান্নাফ! এ কেমন
প্রতিবেশী সূলভ আচরণ?” আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল (আবু সুফিয়ানের বোন)
প্রতি রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের দরজার সামনে
কাঁটাগাছের ডালপালা ছড়িয়ে রেখে দিতো। এটা ছিল তার প্রতিদিনের স্থায়ী আচরণ।
যাতে রসূলুল্লাহ (সা.) বা তাঁর শিশু সন্তানরা বাইরে বের হলে তাদের পায়ে
কাঁটা বিঁধে যায়। (বায়হাকী, ইবন আবী হাতেম, ইবনে জারীর, ইবনে আসাকির ও ইবনে
হিশাম)।
নবুওয়াত লাভের পূর্বে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর
দুই মেয়েকে আবু লাহাবের দুই ছেলে উতবা ও উতাইবার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন।
নবুওয়াতের পরে যখন তিনি ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে শুরু করেন তখন আবু লাহাব
তার দুই ছেলেকে বলে, তোমরা মুহাম্মাদের (রসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম) মেয়েদের তালাক না দিলে আমার পক্ষে তোমাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত
হারাম হয়ে যাবে। কাজেই দু’জনেই তাদের স্ত্রীদের তালাক দেয়। উতাইবা
জাহেলিয়াতের মধ্যে খুব বেশী অগ্রসর হয়ে যায়। সে একদিন রসূলুল্লাহর (সা.)
সামনে এসে বলেঃ আমি (আরবী-------------------------------) এবং
(আরবী-----------) অস্বীকার করছি। একথা বলে তাঁর দিকে থুথু নিক্ষেপ করে।
থুথু তাঁর গায়ে লাগেনি। তিনি বলেনঃ হে আল্লাহ! তোমার কুকুরদের মধ্য থেকে
একটি কুকুর এর ওপর চাপিয়ে দাও। এরপর উতাইবা তার বাপের সাথে সিরিয়া সফরে
রওয়ানা হয়। সফরকালে রাতে তাদের কাফেলা এক জায়গায় অবস্থান করে। স্থানীয়
লোকেরা জানায়, সেখানে রাতে হিংস্র জানোয়ারদের আনাগোনা হয়। আবু লাহাব তার
কুরাইশী সাথীদের বলে, আমার ছেলের হেফাজতের ভালো ব্যবস্থা করো। কারণ আমি
মুহাম্মাদের (সা.) বদ দোয়ার ভয় করছি। একথায় কাফেলার লোকেরা উতাইবার চারদিকে
নিজেদের উটগুলোকে বসিয়ে দেয় এবং তারা নিজেরা ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে একটি
বাঘ আসে। উটদের বেষ্টনী ভেদ করে উতাইবাকে ধরে এবং সেখানেই তাকে
ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে খেয়ে ফেলে (আল ইসতিআব লি ইবনে আবদিল বার, আল ইসাবা লি
ইবনে হাজার, দালায়েলুন নুবুওয়া লি আবী নাঈম আল ইসফাহানী ও রওদুল উনুফ লিস
সুহাইলী)। বর্ণনাগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। কোন কোন বর্ণনাকারী
তালাকের ব্যাপারটি নবুওয়াতের ঘোষণার পরের ঘটনা বলেন। আবার কোন কোন
বর্ণনাকারীর মতে “তাব্বাত ইয়াদা আবী লাহাব” এর নাযিলের পরই তালাকের ঘটনাটি
ঘটে। আবার আবু লাহাবের এ তালাক দানকারী ছেলেটি উতবা ছিল না উতাইবা--- এ
ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর উতবা ইসলাম গ্রহণ করে
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুবারক হাতে বাই’আত গ্রহণ
করেন, একথা প্রামাণিত সত্য। তাই আবু লাহাবের তালাকদানকারী ছেলেটি যে উতাইবা
ছিল, এতে সন্দেহ নেই।
সে যে কেমন জঘন্য মানসিকতার অধিকারী ছিল তার পরিচয় একটি ঘটনা থেকেই পাওয়া
যায়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছেলে হযরত আবুল কাসেমের
ইন্তিকালের পর তাঁর দ্বিতীয় ছেলে হযরত আবদুল্লাহরও ইন্তিকাল হয়। এ অবস্থায়
আবু লাহাব তার ভাতিজার শোকে শরীক না হয়ে বরং আনন্দে আত্মহারা হয়ে দৌঁড়ে
কুরাইশ সরদারদের কাছে পৌঁছে যায়। সে তাদেরকে জানায়ঃ শোনো, আজ মুহাম্মাদের
(রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম নিশানা মুছে গেছে। তার এ
ধরনের আচরণের কথা আমরা ইতিপূর্বে সূরা কাউসারের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করে
এসেছি। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে যেখানে ইসলামের
দাওয়াত দিতে যেতেন আবু লাহাবও তাঁর পেছনে পেছনে সেখানে গিয়ে পৌঁছতো এবং
লোকদের তাঁর কথা শুনার কাজে বাধা দিতো। রাবী’আহ ইবনে আব্বাদ আদদীলী (রা.)
বর্ণনা করেন, আমি একদিন আমার আব্বার সাথে যুল-মাজাযের বাজারে যাই। তখন আমার
বয়স ছিল কম। সেখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামকে দেখি। তিনি
বলছিলেনঃ “হে লোকেরা! বলো, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। একথা বললেই তোমরা
সফলকাম হয়ে যাবে।” এ সময় তাঁর পেছনে পেছনে এক ব্যক্তি বলে চলছিল, “এ
ব্যক্তি মিথ্যুক, নিজের ধর্ম থেকে বিচ্যূত হয়ে গেছে।” আমি জিজ্ঞেস করি, এ
লোকটি কে? লোকেরা বললো ওঁর চাচা আবু লাহাব। (মুসনাদে আহমাদ ও বায়হাকী) এ
একই বর্ণনাকারী হযরত রাবীআহ (রা.) থেকে আর একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতে
বলা হয়েছে, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখলাম। তিনি
প্রত্যেকটি গোত্রের শিবিরে যাচ্ছিলেন এবং বলছিলেনঃ “হে বনী অমুক! আমি
তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রসূল। তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছি,
একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করো না। তোমরা
আমাকে সত্য নবী বলে মেনে নাও এবং আমার সাথে সহযোগিতা করো। এভাবে আল্লাহ
আমাকে যে কাজ করার জন্য পাঠিয়েছেন তা আমি পূর্ণ করতে পারবো।” তাঁর পিছে
পিছে আর একটি লোক আসছিল এবং সে বলছিলঃ “হে বনী অমুক! এ ব্যক্তি নিজে যে
নতুন ধর্ম ও ভ্রষ্টতা নিয়ে এসেছে লাত ও উযযার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তোমাদের
সেদিকে নিয়ে যেতে চায়। এর কথা একদম মেনো না এবং এর পেছনেও চলো না।” আমি
আমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করলামঃ এ লোকটি কে? তিনি বললেনঃ এ লোকটি ওঁরই চাচা
আবু লাহাব। (মুসনাদে আহমাদ ও তাবারানী) তারেক ইবনে আবদুল্লাহ আল মাহারেবীর
(রা.) রেওয়ায়াতও প্রায় এ একই ধরনের। তিনি বর্ণনা করেছেনঃ যুল মাজাযের
বাজারে দেখলাম, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের বলে
যাচ্ছেন, “হে লোকেরা! তোমরা লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো, তাহলে সফলকাম হয়ে
যাবে।” ওদিকে তাঁর পিছে পিছে একজন লোক তাঁকে পাথর মেরে চলছে। এভাবে তাঁর
পায়ের গোড়ালি রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এই সাথে সাথে ঐ ব্যক্তি বলে চলেছে, “এ
মিথ্যুক, এর কথা শুনো না।” আমি লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, এ লোকটি কে? লোকেরা
বললোঃ ওঁরই চাচা আবু লাহাব। (তিরমিযী)
নবুওয়াতের সপ্তম বছরে কুরাইশদের সমস্ত পরিবার মিলে যখন বনি হাশেম ও বনী
মুত্তালিবকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট করলো এবং এ পরিবার দু’টি রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমর্থনে অবিচল থেকে আবু তালেব গিরিপথে
অন্তরীণ হয়ে গেলো তখন একমাত্র আবু লাহাবই নিজের পরিবার ও বংশের সহগামী না
হয়ে কুরাইশ কাফেরদের সহযোগী হলো। এ বয়কট তিন বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ
সময় বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে অনেক সময় অনাহারে থাকতে হয়েছে। কিন্তু আবু
লাহাবের ভূমিকা ছিল মারমুখী। বাইর থেকে মক্কায় কোন বাণিজ্য কাফেলা এলে আবু
তালেব গিরিপথে অন্তরীণদের মধ্য থেকে কেউ তাদের কাছ থেকে খাদ্যদ্রব্য কিনতে
যেতো। আবু লাহাব তখন চিৎকার করে বনিকদেরকে বলতোঃ ওদের কাছে এতো বেশী দাম
চাও যাতে ওরা কিনতে না পারে। এজন্য তোমাদের যত টাকা ক্ষতি হয় তা আমি দেবো।
কাজেই তারা বিরাট দাম হাঁকতো। ক্রেতা মহাসংকটে পড়তো। শেষে নিজের অনাহারের
কষ্ট বুকে পুষে রেখে খালি হাতে পাহাড়ে ফিরে যেতে হতো ক্ষুধা কাতর সন্তানদের
কাছে। তারপর আবু লাহাব সেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সেই পণ্যগুলোই বাজার দরে
কিনে নিতো। (ইবনে সা’দ ও ইবনে হিশাম)
এ সূরায় যে ব্যক্তিটির নাম নিয়ে নিন্দা করা হয়েছে এগুলো ছিল তারই
কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে এর প্রয়োজন এজন্য দেখা দিয়েছিল যে, মক্কার বাইরের
আরবের যেসব লোকেরা হজ্জের জন্য আসতো অথবা বিভিন্ন স্থানে যেসব বাজার বসতো
সেখানে যারা জমায়েত হতো, তাদের সামনে যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের নিজের চাচা তাঁর পিছনে ঘুরে ঘুরে তাঁর বিরোধিতা করতো তখন
বাইরের লোকদের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়তো। কারণ আরবের প্রচলিত ঐতিহ্য
অনুসারে কোন চাচা বিনা কারণে অন্যদের সামনে তার নিজের ভাতিজাকে গালিগালাজ
করবে, তার গায়ে পাথর মারবে এবং তার প্রতি দোষারোপ করবে এটা কল্পনাতীত ছিল।
তাই তারা আবু লাহাবের কথায় প্রভাবিত হয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে পড়ে যেতো। কিন্তু এ সূরাটি নাযিল
হবার পর যখন আবু লাহাব রাগে অন্ধ হয়ে আবোল-তাবোল বকতে লাগলো তখন লোকেরা
বুঝতে পারলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতার
ব্যাপারে তার কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সে নিজের ভাতিজার শত্রুতায় অন্ধ হয়ে
গেছে।
তাছাড়া নাম নিয়ে নিজের চাচার নিন্দা করার পর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দ্বীনের ব্যাপারে কারো মুখ চেয়ে কোন প্রকার সমঝোতা
বা নরম নীতি অবলম্বন করবেন, এ আশা চিরতরে নির্মূল হয়ে গেলো। যখন প্রকাশ্যে
ঘোষণার মাধ্যমে রসূলের চাচার নিন্দা করা হলো তখন লোকেরা বুঝতে পারলো, এখানে
কোন কিছু রেখে ঢেকে করার অবকাশ নেই। এখানে ঈমান আনলে পরও আপন হয়ে যায় এবং
ইসলামের বিরোধিতা ও কুফরী করলে আপনও হয়ে যায় পর। এ ব্যাপারে অমুকের ছেলে,
অমুকের ভাই বা অমুকের বাপের কোন গুরুত্ব নেই।
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন