আল মুদ্দাস্সির-74
|
১.)
হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী,১
|
|
২.)
ওঠো এবং সাবধান করে দাও,২
|
|
৩.)
তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো,৩
|
|
৪.)
তোমার পোশাক পবিত্র রাখো,৪
|
|
৫.)
অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো,৫
|
|
৬.)
বেশী লাভ করার জন্য ইহসান করো না৬
|
|
৭.)
এবং তোমার রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করো।৭
|
|
৮.)
তবে যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে,
|
|
৯.)
সেদিনটি অত্যন্ত কঠিন দিন হবে।৮
|
|
১০.)
কাফেরদের জন্য মোটেই সহজ হবে না। ৯
|
|
|
১২.)
তাকে অঢেল সম্পদ দিয়েছি
|
|
১৩.)
এবং আরো দিয়েছি সবসময় কাছে থাকার মত অনেক পুত্র সন্তান।১২
|
|
১৪.)
তার নেতৃত্বের পথ সহজ করে দিয়েছি।
|
|
১৫.)
এরপরও সে লালায়িত, আমি যেন তাকে আরো বেশী দান করি।১৩
|
|
১৬.)
তা কখনো নয়, সে আমার আয়াতসমূহের সাথে শত্রুতা পোষণ করে।
|
|
১৭.)
অচিরেই আমি তাকে এক কঠিন স্থানে চড়িয়ে দেব।
|
|
১৮.)
সে চিন্তা-ভাবনা করলো এবং একটা ফন্দি উদ্ভাবনের চেষ্টা করলো।
|
|
১৯.)
অভিশপ্ত হোক সে, সে কি ধরনের ফন্দি উদ্ভাবনের চেষ্টা করলো?
|
|
২০.)
আবার অভিশপ্ত হোক সে, সে কি ধরনের ফন্দি উদ্ভাবনের চেষ্টা করলো?
|
|
২১.)
অতঃপর সে মানুষের দিকে চেয়ে দেখলো।
|
|
২২.)
তারপর ভ্রুকুঞ্চিত করলো এবং চেহারা বিকৃত করলো।
|
|
২৩.)
অতঃপর পেছন ফিরলো এবং দম্ভ প্রকাশ করলো।
|
|
২৪.)
অবশেষে বললোঃ এ তো এক চিরাচরিত যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।
|
|
২৫.)
এ তো মানুষের কথা মাত্র।১৪
|
|
২৬.)
শিগগিরই আমি তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবো।
|
|
২৭.)
তুমি কি জানো, সে দোযখ কি?
|
|
২৮.)
যা জীবিতও রাখবে না আবার একেবারে মৃত করেও ছাড়বে না।১৫
|
|
২৯.)
গায়ের চামড়া ঝলসিয়ে দেবে।১৬
|
|
৩০.)
সেখানে নিয়োজিত আছে উনিশ জন কর্মচারী।
|
|
৩১.)
আমি১৭ ফেরেশতাদের দোযখের কর্মচারী বানিয়েছি ১৮ এবং তাদের সংখ্যাকে কাফেরদের জন্য ফিতনা বানিয়ে দিয়েছি।১৯ যাতে আহলে কিতাবদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে।২০ ঈমানদারদের ঈমান বৃদ্ধি পায়,২১ আহলে কিতাব ও ঈমানদাররা সন্দেহ পোষণ না করে২২ আর যাদের মনে রোগ আছে তারা এবং কাফেররা যেন বলে, এ অভিনব কথা দ্বারা আল্লাহ কি বুঝাতে চেয়েছে?২৩ এভাবে আল্লাহ যাকে চান পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে চান হিদয়াত দান করেন।২৪ তোমার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কেউ অবহিত নয়।২৫ আর দোযখের এ বর্ণনা এছাড়া আর কোন উদ্দেশ্যই নয় যে, মানুষ তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে। ২৬
|
|
৩২.)
কখ্খনো না, ২৭ চাঁদের শপথ,
|
|
৩৩.)
আর রাতের শপথ যখন তার অবসান ঘটে।
|
|
৩৪.)
ভোরের শপথ যখন তা আলোকোজ্জল হয়ে উঠে।
|
|
৩৫.)
এ দোযখও বড় জিনিসগুলোর একটি।২৮
|
|
৩৬.)
মানুষের জন্য ভীতিকর।
|
|
৩৭.)
যে অগ্রসর হতে চায় বা পেছনে পড়ে থাকতে চায় ২৯ তাদের সবার জন্য।
|
|
৩৮.)
প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের কাছে দায়বদ্ধ। ৩০
|
|
৩৯.)
তবে ডান দিকের লোকেরা ছাড়া৩১
|
|
৪০.)
যারা জান্নাতে অবস্থান করবে।
|
|
৪১.)
সেখানে তারা অপরাধীদের জিজ্ঞেস করতে থাকবে৩২
|
|
৪২.)
কিসে তোমাদের দোযখে নিক্ষেপ করলো।
|
|
৪৩.)
তারা বলবেঃ আমরা নামায পড়তাম না।৩৩
|
|
৪৪.)
অভাবীদের খাবার দিতাম না। ৩৪
|
|
৪৫.)
সত্যের বিরুদ্ধে অপবাদ রটনাকারীদের সাথে মিলে আমরাও রটনা করতাম;
|
|
৪৬.)
প্রতিফল দিবস মিথ্যা মনে করতাম।
|
|
৪৭.)
শেষ পর্যন্ত আমরা সে নিশ্চিত জিনিসের মুখোমুখি হয়েছি।৩৫
|
|
৪৮.)
সে সময় সুপারিশকারীদের কোন সুপারিশ তাদের কাজে আসবে না।৩৬
|
|
৪৯.)
এদের হলো কি যে এরা এ উপদেশবাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে
|
|
৫০.)
যেন তারা বাঘের ভয়ে
|
|
৫১.)
পালায়নপর বন্য গাধা।৩৭
|
|
৫২.)
বরং তারা প্রত্যেকে চায় যে, তার নামে খোলা চিঠি পাঠানো হোক।৩৮
|
|
৫৩.)
তা কখখনো হবে না। আসল কথা হলো, এরা আখেরাতকে আদৌ ভয় করে না।৩৯
|
|
৫৪.)
কখখনো না৪০ এ তো একটি উপদেশ বাণী।
|
|
৫৫.)
এখন কেউ চাইলে এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক।
|
|
নামকরণ
প্রথম আয়াতে (আরবী------) (আল মুদ্দাস্সির) শব্দটিকে এ সূরার নাম হিসেবে
গ্রহণ করা হয়েছে। এটিও শুধু সূরার নাম। এর বিষয় ভিত্তিক শিরোনাম নয়।
নাযিল হওয়ার সময়-কাল
এর প্রথম সাতটি আয়াত পবিত্র মক্কা নগরীতে নবুওয়াতের একেবারে প্রাথমিক যুগে
নাযিল হয়েছিল। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী এবং
মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থের কোন কোন রেওয়ায়াতে এতদূর
পর্যন্ত বলা হয়েছে যে, এগুলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের ওপর নাযিল হওয়া সর্বপ্রথম আয়াত। কিন্তু গোটা মুসলিম উম্মাহর
কাছে এ বিষয়টি প্রায় সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের ওপর সর্বপ্রথম যে অহী নাযিল হয়েছিল তা ছিল
(আরবী------------) (ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক) থেকে
(আরবী-----------------) (মালাম ইয়া’লাম) পর্যন্ত। তবে বিশুদ্ধ
রেওয়ায়াতসমূহ থেকে একথা প্রমাণিত যে, এ প্রথম অহী নাযিল হওয়ার পর কিছুকাল
পর্যন্ত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহী নাযিল হয়নি।
এ বিরতির পর নতুন করে আবার অহী নাযিলের ধারা শুরু হলে সূরা মুদ্দাস্সিরের এ
আয়াতগুলো থেকেই তা শুরু হয়েছিল। ইমাম যুহরী এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন
এভাবেঃ
“কিছুকাল পর্যন্ত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহী
নাযিল বন্ধ রইলো। সে সময় তিনি এতো কঠিন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন যে,
কোন কোন সময় পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সেখান থেকে নিজেকে নীচে নিক্ষেপ করতে বা
গড়িয়ে ফেলে দিতে উদ্যত হতেন। কিন্তু যখনই তিনি কোন চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছতেন
তখনই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর সামনে এসে বলতেনঃ ‘আপনি তো আল্লাহর নবী’
এতে তাঁর হৃদয় মন প্রশান্তিতে ভরে যেতো এবং তাঁর অশ্বস্তি ও অস্থিরতার ভাব
বিদূরিত হতো।” (ইবনে জারীর)
এরপর ইমাম যুহরী নিজে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর রেওয়ায়তেই এভাবে উদ্ধৃত করেছেনঃ
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম (আরবী------------) (অহী বন্ধ
থাকার সময়)-এর কথা উল্লেখ করে বলেছেনঃ একদিন আমি পথে চলছিলাম। হঠাৎ আসমান
থেকে একটি আওয়াজ শুনতে পেলাম। ওপরের দিকে তাকিয়েই দেখতে পেলাম হেরা গিরা
গুহায় যে ফেরেশতা আমার কাছে এসেছিল সে ফেরেশতা আসমান ও যমীনের মাঝখানে একটি
আসন পেতে বসে আছে। এ দৃশ্য দেখে আমি অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম এবং
বাড়ীতে পৌঁছেই বললামঃ আমাকে চাদর দিয়ে আচ্ছাদিত করো। আমাকে চাদর দিয়ে
আচ্ছাদিত করো। সুতরাং বাড়ীর লোকজন আমাকে লেপ (অথবা কম্বল) দিয়ে আমাকে
আচ্ছাদিত করলো। এ অবস্থায় আল্লাহ অহী নাযিল করলেনঃ (আরবী……………) (ইয়া
আয়্যুহাল মুদ্দাস্সির) “এরপর অব্যাহতভাবে অহী নাযিল হতে থাকলো।” (বুখারী,
মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে জারীর)।
প্রকাশ্যভাবে ইসলামের প্রচার শুরু হওয়ার পর প্রথমবার মক্কায় হজ্জের মওসুম
সমাগত হলে সূরার অবশিষ্ট অংশ অর্থাৎ ৮ আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত নাযিল হয়।
‘সীরাতে ইবনে হিশাম’ গ্রন্থে এ ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা
পরে তা উল্লেখ করবো।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের প্রতি সর্বপ্রথম যে অহী পাঠানো হয়েছিল তা ছিল সূরা ‘আলাকে’র
প্রথম পাঁচটি আয়াত। এতে শুধু বলা হয়েছিলঃ
“পড় তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘জমাট
রক্ত’ থেকে। পড়, তোমার রব বড় মহানুভব। যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান
শিখিয়েছেন। তিনি মানুষকে এমন জ্ঞান শিখিয়েছেন যা সে জানতো না।”
এটা ছিল অহী নাযিল হওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম সহসা এ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কত বড় মহান কাজের জন্য তিনি
আদিষ্ট হয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরো কি কি কাজ তাকে করতে হবে এ বাণীতে তাঁকে
সে বিষয়ে কিছুই জানানো হয়েছিল না। বরং শুধু একটি প্রাথমিক পরিচয় দিয়েই
কিছু দিনের জন্য অবকাশ দেয়া হয়েছিল যাতে অহী নাযিলের এ প্রথম অভিজ্ঞতা থেকে
তাঁর মন-মানসিকতার ওপর যে কঠিন চাপ পড়েছিল তার প্রভাব বিদূরিত হয়ে যায় এবং
ভবিষ্যতে অহী গ্রহণ ও নবুওয়াতের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য তিনি
মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যান। এ বিরতির পর পুনরায় অহী নাযিলের ধারা শুরু
হলে এ সূরার প্রথম সাতটি আয়াত নাযিল হয় এবং এর মাধ্যমে প্রথমবারের মত নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ মর্মে আদেশ দেয়া হয় যে, আপনি উঠুন এবং
আল্লাহর বান্দারা এখন যেভাবে চলছে তার পরিণাম সম্পর্কে তাদের সাবধান করে
দিন। আর এ পৃথিবীতে এখন যেখানে অন্যদের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব জেঁকে বসেছে,
সেখানে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের ঘোষণা দিন। এর সাথে সাথে তাঁকে
নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, এখন থেকে আপনাকে যে কাজ করতে হবে তার দাবি হলো
আপনার নিজের জীবন যেন সব দিক থেকে পূত-পবিত্র হয় এবং আপনি সব রকমের পার্থিব
স্বার্থ উপেক্ষা করে পূর্ণ নিষ্ঠা ও ঐক্যান্তিকতার সাথে আল্লাহর সৃষ্টির
সংস্কার-সংশোধনের দায়িত্ব পালন করেন। অতপর শেষ বাক্যটিতে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যে
কোন কঠিন পরিস্থিতি এবং বিপদ মুসিবতই আসুক না কেন আপনি আপনার প্রভুর
উদ্দেশ্যে ধৈর্য অবলম্বন করুন।
আল্লাহর এ ফরমান কার্যকরী করার জন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম যখন ইসলামের প্রচার শুরু করলেন এবং একের পর এক কুরআন মজীদের যেসব
সূরা নাযিল হচ্ছিলো তা শুনাতে থাকলেন তখন মক্কায় রীতিমত হৈ চৈ পড়ে গেল এবং
বিরোধিতার এক তুফান শুরু হলো। এ অবস্থায় কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর
হজ্জের মওসূম এসে পড়লে মক্কার লোকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। তারা ভাবলো, এ
সময় সমগ্র আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজীদের কাফেলা আসবে, মুহাম্মাদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি যদি এসব কাফেলার অবস্থান স্থলে হাজির হয়ে হাজীদের সাথে
সাক্ষাত করেন এবং বিভিন্ন স্থানে হজ্জের জনসমাবেশসমূহে দাঁড়িয়ে কুরআনের মত
অতুনীয় এ মর্মস্পর্শী বাণী শুনাতে থাকেন তাহলে সমগ্র আরবের আনাচে কানাচে
তাঁর আহবান পৌঁছে যাবে এবং না জানি কত লোক তাতে প্রভাবিত হয়ে পড়বে। তাই
কুরাইশ নেতারা একটি সম্মেলনের ব্যবস্থা করলো। এতে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে,
মক্কায় হাজীদের আগমনের সাথে সাথে তাদের মধ্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া
সাল্লামের বিরুদ্ধে প্রচার প্রোপাগাণ্ডা শুরু করতে হবে। এ বিষয়ে ঐক্যমত
হওয়ার পর ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা সমবেত সবাইকে উদ্দেশ করে বললোঃ আপনারা যদি
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে লোকদের কাছে
বিভিন্ন রকমের কথা বলেন, তাহলে আমাদের সবার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাবে।
তাই কোন একটি বিষয় স্থির করে নিন যা সবাই বলবে। কেউ কেউ প্রস্তাব করলো,
আমরা মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গণক বলবো। ওয়ালীদ
বললোঃ তা হয় না। আল্লাহর শপথ, সে গণক নয়। আমরা গণকের অবস্থা জানি। তারা
গুণ গুণ শব্দ করে যেসব কথা বলে এবং যে ধরনের কথা বানিয়ে নেয় তার সাথে
কুরআনের সামান্যতম সাদৃশ্যও নেই। তখন কিছু সংখ্যক লোক প্রস্তাব করলো যে,
তাঁকে পাগল বলা হোক। ওয়ালীদ বললোঃ সে পাগলও নয়। আমরা পাগল ও বিকৃত
মস্তিষ্ক লোক সম্পর্কেও জানি। পাগল বা বিকৃত মস্তিষ্ক হলে মানুষ যে ধরনের
অসলংগ্ন ও আবোল তাবোল কথা বলে এবং খাপছাড়া আচরণ করে তা কারো অজানা নয়।
কে একথা বিশ্বাস করবে যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে
বাণী পেশ করছে তা পাগলের প্রলাপ অথবা জিনে ধরা মানুষের উক্তি? লোকজন
বললোঃ তাহলে আমরা তাঁকে কবি বলি। ওয়ালীদ বললোঃ সে কবিও নয়। আমরা সব
রকমের কবিতা সম্পর্কে অবহিত। কোন ধরনের কবিতার সাথে এ বাণীর সাদৃশ্য নেই।
লোকজন আবার প্রস্তাব করলোঃ তাহলে তাঁকে যাদুকর বলা হোক।ওয়ালীদ বললোঃ সে
যাদুকরও নয়। যাদুকরদের সম্পর্কেও আমরা জানি। যাদু প্রদর্শনের জন্য তারা
যেসব পন্থা অবলম্বন করে থাকে সে সম্পর্কেও আমাদের জানা আছে। একথাটিও
মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ব্যাপারে খাটে না। এরপর
ওয়ালীদ বললোঃ প্রস্তাবিত এসব কথার যেটিই তোমরা বলবে সেটিকেই লোকেরা
অযথা অভিযোগ মনে করবে। আল্লাহর শপথ, এ বাণীতে আছে অসম্ভব রকমের মাধুর্য।
এর শিঁকড় মাটির গভীরে প্রোথিত আর এর শাখা-প্রশাখা অত্যন্ত ফলবান। একথা
শুনে আবু জেহেল ওয়ালীদকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। সে বললোঃ যতক্ষণ না তুমি
মুহাম্মাদ সম্পর্কে কোন কথা বলছো ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার কওমের লোকজন
তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না। সে বললোঃ তাহলে আমাকে কিছুক্ষণ ভেবে দেখতে
দাও। এরপর সে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে বললোঃ তাঁর সম্পর্কে সর্বাধিক
গ্রহণযোগ্য যে কথাটি বলা যেতে পারে তা হলো, তোমরা আরবের জনগণকে বলবে যে,
এ লোকটি যাদুকর। সে এমন কথা বলে যা মানুষকে তার পিতা, মাতা, স্ত্রী,
পুত্র এবং গোটা পরিবার থেকেই বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ওয়ালীদের একথা গ্রহণ
করলো। অতপর হজ্জের মওসূমে পরিকল্পনা অনুসারে কুরাইশদের বিভিন্ন প্রতিনিধি
দল হাজীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো এবং বহিরাগত হজ্জযাত্রীদের তারা এ বলে সাবধান
করতে থাকলো যে, এখানে একজন বড় যাদুকরের আর্বিভাব ঘটেছে। তার যাদু
পরিবারের লোকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দেয়। তাঁর ব্যাপারে সাবধান
থাকবেন। কিন্তু এর ফল দাঁড়ালো এই যে, কুরাইশ বংশীয় লোকেরা নিজেরাই
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম সমগ্র আরবে পরিচিত করে
দিল। (সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৮-২৮৯। আবু জেহেলের
পীড়াপীড়িতেই যে ওয়ালীদ এ উক্তি করেছিল, সে কথা ইবনে জারীর তার তাফসীরে
ইকরিমার রেওয়ায়াত সূত্র উদ্ধৃত করেছেন)।
এ সূরার দ্বিতীয় অংশে এ ঘটনারই পর্যালোচনা করা হয়েছে। এর বিষয়বস্তুর বিন্যাস হয়েছে এভাবেঃ
৮ থেকে ১০ আয়াত পর্যন্ত ন্যায় ও সত্যকে অস্বীকারকারীদের এ বলে সাবধান করা
হয়েছে যে, আজ তারা যা করছে কিয়ামতের দিন তারা নিজেরাই তার খারাপ পরিণতির
সম্মুখীন হবে।
১১ থেকে ২৬ আয়াত পর্যন্ত ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার নাম উল্লেখ না করে বলা
হয়েছেঃ মহান আল্লাহ এ বক্তিকে অঢেল নিয়ামত দান করেছিলেন। কিন্তু এর বিনিময়ে
সে ন্যায় ও সত্যের সাথে চরম দুশমনী করেছে। এ পর্যায়ে তার মানসিক
দ্বন্দ্বের পূর্ণাঙ্গ চিত্র অংকন করা হয়েছে। একদিকে সে মনে মনে মুহাম্মাদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনের প্রতি সত্যতা স্বীকার করে
নিয়েছিল। কিন্তু অপরদিকে নিজ গোত্রের মধ্যে সে তার নেতৃত্ব, মর্যাদা ও
প্রভাব-প্রতিপত্তিও বিপন্ন করতে প্রস্তুত ছিল না। তাই সে শুধু ঈমান গ্রহণ
থেকেই বিরত রইলো না। বরং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নিজের বিবেকের সাথে বুঝা পড়া ও
দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পর আল্লাহর বান্দাদের এ বাণীর ওপর ঈমান আনা থেকে বিরত
রাখার জন্য প্রস্তাব করলো যে, এ কুরআনকে যাদু বলে আখ্যায়িত করতে হবে। তার এ
স্পষ্ট ঘৃণ্য মানসিকতার মুখোশ খুলে দেয়ার জন্য বলা হয়েছে যে, নিজের এতো
সব অপকর্ম সত্ত্বেও এ ব্যক্তি চায় তাকে আরো পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হোক।
অথচ এখন সে পুরষ্কারের যোগ্য নয় বরং দোযখের শাস্তির যোগ্য হয়ে গিয়েছে।
এরপর ২৭ থেকে ৪৮ আয়াত পর্যন্ত দোযখের ভয়াবহতার উল্লেখ করা হয়েছে এবং
কোন্ ধরনের নৈতিক চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের অধিকারী লোকেরা এর উপযুক্ত বলে
গণ্য হবে তা বর্ণনা করা হয়েছে।
অতপর ৪৯-৫৩ আয়াতে কাফেরদের রোগের মূল ও উৎস কি তা বলে দেয়া হয়েছে। বলা
হয়েছে যেহেতু তারা আখেরাত সম্পর্কে বেপরোয়া ও নির্ভীক এবং এ পৃথিবীকেই
জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে মনে করে, তাই তারা কুরআন থেকে এমনভাবে পালায়,
যেমন বন্য গাধা বাঘ দেখে পালায়। তারা ঈমান আনার জন্য নানা প্রকারের
অযৌক্তিক পূর্বশর্ত আরোপা করে। অথচ তাদের সব শর্ত পূরণ করা হলেও আখেরাতকে
অস্বীকার করার কারণে তারা ঈমানের পথে এক পাও অগ্রসর হতে সক্ষম নয়।
পরিশেষে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে, আল্লাহর কারো ঈমানের প্রয়োজন নেই
যে, তিনি তাদের শর্ত পূরণ করতে থাকবেন। কুরআন সবার জন্য এক উপদেশবাণী যা
সবার সামনে পেশ করা হয়েছে। কারো ইচ্ছা হলে সে এ বাণী গ্রহণ করবে। আল্লাহই
একমাত্র এমন সত্তা, যার নাফরমানী করতে মানুষের ভয় পাওয়া উচিত। তাঁর
মাহাত্ম্য ও মর্যাদা এমন যে, যে ব্যক্তিই তাকওয়া ও আল্লাহভীতির পথ অনুসরণ
করে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন। পূর্বে সে যতই নাফরমানী করে থাকুক না কেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন