আদ্ দাহর-76
|
১.)
মানুষের ওপরে কি অন্তহীন মহাকালের এমন একটি সময়ও অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযোগ্য কোন জিনিসই ছিল না?১
|
|
|
৩.)
আমি তাকে রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছি। এরপর হয় সে শোকরগোজার হবে নয়তো হবে কুফরের পথ অনুসরণকারী।৫
|
|
৪.)
আমি কাফেরদের জন্য শিকল, বেড়ি এবং জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি।
|
|
৫.)
(বেহেশতে) নেককার লোকেরা৬ পানপাত্র থেকে এমন শরাব পান করবে যাতে কর্পূর পানি সংমিশ্রিত থাকবে।
|
|
|
৭.)
এরা হবে সেসব লোক যারা (দুনিয়াতে) মানত পূরণ করে১০ সে দিনকে ভয় করে যার বিপদ সবখানে ছড়িয়ে থাকবে।
|
|
|
৯.)
এবং (তাদেরকে বলে) আমরা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই তোমাদের খেতে দিচ্ছি। আমরা তোমাদের কাছে এর কোন প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা১৪ পেতে চাই না।
|
|
১০.)
আমরা তো আমাদের রবের পক্ষ থেকে সেদিনের আযাবের ভয়ে ভীত, যা হবে কঠিন বিপদ ভরা অতিশয় দীর্ঘ দিন।
|
|
১১.)
আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে সেদিনের অকল্যাণ থেকে রক্ষা করবেন এবং তাদেরকে সজীবতা ও আনন্দ দান করবেন।১৫
|
|
১২.)
আর তাদের সবরের বিনিময়ে১৬ তাদেরকে জান্নাত ও রেশমী পোশাক দান করবেন।
|
|
১৩.)
তারা সেখানে উঁচু আসনের ওপরে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে রোদের উত্তাপ কিংবা শীতের তীব্রতা তাদের কষ্ট দেবে না।
|
|
১৪.)
জান্নাতের বৃক্ষরাজির ছায়া তাদের ওপর ঝুঁকে পড়ে ছায়া দিতে থাকবে। আর তার
ফলরাজি সবসময় তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে (তারা যেভাবে ইচ্ছা চয়ন করতে
পারবে)।
|
|
|
১৬.)
যা (জান্নাতের ব্যবস্থাপকরা) যথাযথ পরিমাণে পূর্ণ করে রাখবে।১৯
|
|
১৭.)
সেখানে তাদের এমন সুরা পাত্র পান করানো হবে যাতে শুকনো আদার সংমিশ্রণ থাকবে।
|
|
১৮.)
এটি জান্নাতের একটি ঝর্ণা যা সালসাবীল নামে অভিহিত।২০
|
|
১৯.)
তাদের সেবার জন্য এমন সব কিশোর বালক সদা তৎপর থাকবে যারা চিরদিনই কিশোর
থাকবে। তুমি তাদের দেখলে মনে করবে যেন ছড়ানো ছিটানো মুক্তা।২১
|
|
২০.)
তুমি সেখানে যে দিকেই তাকাবে সেদিকেই শুধু নিয়ামত আর ভোগের উপকরণের সমাহার
দেখতে পাবে এবং বিশাল সাম্রাজ্যের সাজ-সরঞ্জাম তোমাদের দৃষ্টিগোচর হবে।২২
|
|
|
২২.)
এ হচ্ছে তোমাদের জন্য প্রতিদান। কারণ, তোমাদের কাজ কর্ম মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছে।২৬
|
|
২৩.)
হে নবী, আমিই তোমার উপর এ কুরআন অল্প অল্প করে নাযিল করেছি।২৭
|
|
|
২৫.)
সকাল সন্ধ্যায় তোমার রবের নাম স্মরণ করো।
|
|
২৬.)
রাতের বেলায়ও তার সামনে সিজদায় অবনত হও। রাতের দীর্ঘ সময় তাঁর তাসবীহ অর্থাৎ পবিত্রতা বর্ণনা করতে থাকো।৩০
|
|
২৭.)
এসব লোক তো দ্রুত লাভ করা যায় এমন জিনিসকে (দুনিয়াকে) ভালবাসে এবং ভবিষ্যতে যে কঠিন দিন আসছে তাকে উপেক্ষা করে চলছে।৩১
|
|
২৮.)
আমিই এদের সৃষ্টি করেছি এবং এদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও সন্ধিস্থল মজবুত
করেছি। আর যখনই চাইবো তাদের আকার-আকৃতি পরিবর্তন করে দেব।৩২
|
|
২৯.)
এটি একটি উপদেশ বাণী। এখন কেউ চাইলে তার রবের দিকে যাওয়ার পথ অবলম্বন করতে পারে।৩৩
|
|
৩০.)
তোমাদের চাওয়ায় কিছুই হয় না যদি আল্লাহ না চান।
|
|
৩১.)
আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সুবিজ্ঞ। যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তাঁর রহমতের মধ্যে শামিল করেন। আর জালেমদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি।৩৪
নামকরণ
সূরার একটি নাম আদ্ দাহর এবং আরেকটি নাম আল ইনসান। দু'টি নামই এর প্রথম আয়াতের هَلْ أَتَى عَلَى الْإِنسَانِ এবং حِينٌ مِّنَ الدَّهْرِ আয়াতাংশ থেকে গৃহীত হয়েছে।
নাযিল হওয়ার সময়-কাল
তাফসীরকারদের অধিকাংশই বলেছেন যে, এটি মক্কায় অবতীর্ণ সূরা। আল্লামা
যামাখশারী (র) ইমাম রাযী, কাজী বায়যাবী, আল্লামা নিজামুদ্দিন নীশাপুরী,
হাফেয ইবনে কাসীর এবং আরো অনেক তাফসীরকার এটিকে মক্কী সূরা বলেই উল্লেখ
করেছেন। আল্লামা আলুসীর মতে এটিই অধিকাংশ মুফাসসিরের মত। কিন্তু অপর কিছু
সংখ্যক তাফসীরকারের মতে পুরা সূরাটিই মাদানী। আবার কারো কারো মতে এটি
মক্কী সূরা হলেও এর ৮ থেকে ১০ পর্যন্ত আয়াতগুলো মদীনায় নাযিল হয়েছে।
অবশ্য এ সূরার বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভঙ্গী মাদানী সূরাসমূহের বিষয়বস্তু ও
বর্ণনাভঙ্গী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বরং এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে স্পষ্ট
বুঝা যায়। এটি যে মক্কায় অবতীর্ণ শুধু তাই নয়, বরং মক্কী যুগেরও সূরা
মুদ্দাসসিরের প্রথম সাতটি আয়াত নাযিল হওয়ার পর যে পর্যায়টি আসে সে সময়
নাযিল হয়েছিল। ৮ থেকে ১০---------থেকে-----------পর্যন্ত আয়াতগুলো গোটা
সূরার বর্ণনাক্রমের সাথে এমনভাবে গাঁথা যে, যদি কেউ পূর্বাপর মিলিয়ে তা পাঠ
করে তাহলে তার মনেই হবে না যে, এর আগের এবং পরের বিষয়বস্তু ১৫-১৬ বছর
পূর্বে নাযিল হয়েছিল এবং এর কয়েক বছর পর নাযিল হওয়া এ তিনটি আয়াত এখানে এনে
জুড়ে দেয়া হয়েছে।
আসলে যে কারণে এ সূরা অথবা এর কয়েকটি আয়াতের মদীনায় অবতীর্ণ হওয়ার ধারণা
সৃষ্টি হয়েছে তা হলো, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আতা বর্ণিত একটি
হাদীস। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, একবার হযরত হাসান ও হুসাইন রাদিয়াল্লাহু
আনহুমা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলইহি ওয়া সাল্লাম এবং
বহু সংখ্যক সাহাবী (রা.) তাঁদের দেখতে ও রোগ সংক্রান্ত খোঁজ-খবর নিতে
যান। কোন কোন সাহাবী (রা.) হযরত আলীকে (রা.) পরামর্শ দেন যে, তিনি যেন
শিশু দু’টির রোগমুক্তির জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোন মানত করেন। অতএব হযরত
আলী (রা.), হয়রত ফাতেমা (রা.) এবং তাঁদের কাজের মেয়ে ফিদ্দা (রা.) মানত
করলেন যে, আল্লাহ তা'আলা যদি শিশু দু’টিকে রোগমুক্ত করেন তাহলে শুকরিয়া
হিসেবে তাঁরা সবাই তিন দিন রোযা রাখবেন। আল্লাহর মেহেরবানীতে উভয়ে সুস্থ
হয়ে উঠলেন এবং তাঁরা তিন জন মানতের রোযা রাখতে শুরু করলেন। হযরত আলীর
(রা.) ঘরে খাবার কিছুই ছিল না। তিনি তিন সা' পরিমাণ যব ধার-কর্জ করে আনলেন
(একটি বর্ণনা অনুসারে মেহনত মজদুরী করে নিয়ে আসলেন)। প্রথম রোযার দিন
ইফতারী করে যখন খাওয়ার জন্য বসেছেন সেসময় একজন মিসকীন এসে খাবার চাইলো।
তারা সব খাবার সে মিসকীনকে দিয়ে দিলেন এবং নিজেরা শুধু পানি পান করে রাত্রি
কাটালেন। দ্বিতীয় দিনও ইফতারীর পর যে সময় খেতে বসেছেন সে সময় একজন ইয়াতীম
এসে কিছু চাইলো। সেদিনও তাঁরা সব খাবার তাকে দিয়ে দিলেন এবং নিজেরা শুধু
পানি পান করে রাত কাটিয়ে দিলেন। তৃতীয় দিন ইফতার করে খাবার জন্য সবেমাত্র
বসেছেন সেসময় একজন বন্দী এসে একইভাবে খাদ্য চাইলো। সেদিনের সব খাবারও তাকে
দিয়ে দেয়া হলো। চতুর্থ দিন হযরত আলী (রা.) বাচ্চা দু'টিকে নিয়ে
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাজির হলে নবী (সা.)
দেখতে পেলেন, অসহ্য ক্ষুধার জ্বালায় পিতা ও দুই ছেলে তিন জনের অবস্থাই
অত্যন্ত সংগীন। তিনি সেখান থেকে উঠে তাঁদের সাথে ফাতেমার (রা.) কাছে বাড়িতে
গিয়ে দেখতে পেলেন তিনিও ঘরের এককোণে ক্ষুধার তীব্র জ্বালায় নিরব নিথর হয়ে
পড়ে আছেন। এ অবস্থা দেখে নবীর (সা.) হৃদয়-মন আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো।
ইতিমধ্যে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে হাজির হলেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ তা'আলা
আপনার পরিবার পরিজনের ব্যাপারে আপনাকে মোবারকবাদ দিয়েছেন। নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেনঃ সেটি কি? জবাবে তিনি গোটা
সূরাটা পাঠ করে শোনালেন। (ইবনে মিহরানের বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, (------)
থেকে সূরার শেষ আয়াত পর্যন্ত শোনালেন। কিন্তু ইবনে মারদুইয়া ইবনে আব্বাস
থেকে বর্ণিত হাদীস বর্ণনা করেছেন তাতে শুধু একটুকু বর্ণনা করা হয়েছে যে,
ويطعممون الطعام আয়াতটি হযরত আলী ও হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা
সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। তাতে এ ঘটনার কোন উল্লেখ নেই।) আলী ইবনে আহমাদ আল
ওয়াহেদী তার তাফসীর গ্রন্থ 'আল বাসীতে' এ ঘটনাটি পুরা বর্ণনা করেছেন।
যামাখশারী, রাযী, নীশাপুরী এবং অন্যান্য মুফাসসিরগণ সম্ভবত সেখান থেকে এ
ঘটনাটি গ্রহণ করেছেন।
এ রেওয়ায়াতটি সনদের দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল। তাছাড়া দেরায়াত বা
বুদ্ধি-বিবেক ও বিচার-বিশ্লেষণের দিক থেকে দেখলেও এ ব্যাপারটা বেশ অদ্ভূত
মনে হয় যে, একজন মিসকীন, একজন ইয়াতীম এবং একজন বন্দী এসে খাদ্য চাচ্ছে আর
তাকে বাড়ীর পাঁচ পাঁচজন লোকের খাদ্য সবটাই দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা কি কোন
যুক্তিসংগত ব্যাপার? একজনের খাদ্য তাকে দিয়ে বাড়ীর পাঁচ জন মানুষ চারজনের
খাদ্য নিজের জন্য যথেষ্ট মনে করতে পারতেন। তাছাড়া একথাও বিশ্বাস করা কঠিন
যে, দু' দু'টি বাচ্চা যারা সবেমাত্র রোগ থেকে নিরাময় লাভ করেছিল এবং
দুর্বল ছিল তাদেরকেও তিন দিন যাবত অভুক্ত রাখা হযরত আলী ও হযরত ফাতেমার
(রা.) মত দ্বীন সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিদ্বয়ও নেকীর কাজ
মনে করে থাকবেন! তাছাড়াও ইসলামী শাসন যুগে কয়েদীদের ব্যাপারে কখনো এ নীতি
ছিল না যে, তাদেরকে ভিক্ষা করার জন্য ছেড়ে দেয়া হবে। তারা সরকারের হাতে
বন্দী হয়ে থাকলে তাদের খাদ্য ও বস্ত্রের ব্যবস্থা সরকারই করতেন। আবার কোন
ব্যক্তির হাতে সোপর্দ করা হয়ে থাকলে তাদের খাদ্য ও বস্ত্র দান করা সে
ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য হতো। তাই কোন বন্দী ভিক্ষা করতে বের হবে
মদীনায় এটা অসম্ভব ব্যাপার। তা সত্ত্বেও সমস্ত বর্ণনা ও যুক্তি-তর্কের
দুর্বলতাসমূহ উপেক্ষা করে এ কাহিনীকে পুরোপুরি সত্য বলে ধরে নিলেও তা থেকে
বড়জোর যা জানা যায় তা শুধু এতটুকু যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের পরিবারের লোকদের দ্বারা এ নেক কাজটি সম্পাদিত হওয়ার কারণে
জিবরাঈল (আ) এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সুখবর শুনিয়েছেন
যে, আল্লাহর কাছে আপনার আহলে বায়তের এ কাজটি অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে। কারণ
তারা ঠিক সে পছন্দনীয় কাজটি করেছেন আল্লাহ তা'আলা যার প্রশংসা সূরা দাহরের এ
আয়াতগুলোতে করেছেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, আয়াত কয়টি এ উপলক্ষেই
নাযিল হয়েছিল। শানে নুযুলের ব্যাপারে বিপুল সংখ্যক রেওয়ায়াতের অবস্থা হলো,
কোন আয়াত সম্পর্কে যখন বলা হয় যে, আয়াতটি অমুক উপলক্ষ্যে নাযিল হয়েছিল
তখন প্রকৃতপক্ষে তার এ অর্থ দাঁড়ায় না যে, যখন এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ঠিক
তখনই এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল। বরং এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আয়াতটি এ ঘটনার
ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রযোজ্য। ইমাম সুয়ূতী তাঁর 'ইতকান' গ্রন্থে হাফেয
ইবনে তাইমিয়ার এ বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন যে, “রাবী যখন বলেন এ আয়াতটি অমুক
ব্যাপারে নাযিল হয়েছে তখন কোন কোন ক্ষেত্রে তার অর্থ হয়, ঐ ব্যাপারটিই
তার নাযিল হওয়ার কারণ। আবার কোন কোন সময় তার অর্থ হয়, ঐ ব্যাপারটি এ
আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত, যদিও তা তার নাযিল হওয়ার কারণ নয়।” এরপর
তিনি ইমাম বদরুদ্দীন যারকাশীর গ্রন্থ 'আল বুরহান ফী উলুমিল কুরআন' থেকে
তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। বক্তব্যটি হলো, “সাহাবা ও তাবেয়ীদের ব্যাপারে
এ নীতি সাধারণ ও সর্বজনবিদিত যে, তাঁদের কেউ যখন বলেন, এ আয়াতটি অমুক
ব্যাপারে নাযিল হয়েছিল তখন তার অর্থ হয়, এ আয়াতের নির্দেশ ঐ ব্যাপারে
প্রযোজ্য। তার এ অর্থ কখনো হয় না যে, উক্ত ঘটনাই এ আয়াতটির নাযিলের কারণ।
প্রকৃতপক্ষে এক্ষেত্রে আয়াতটি থেকে দলীল পেশ করা হয় মাত্র। তা দ্বারা ঘটনা
বর্ণনা করা উদ্দেশ্য হয় না।” (আল ইতকান ফী উলুমিল কোরআন, প্রথম খণ্ড,
পৃষ্ঠা ৩১, মুদ্রণ ১৯২৯ ইং)
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
এ সূরার বিষয়বস্তু হলো দুনিয়ায় মানুষকে তার প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান
সম্পর্কে অবহিত করা। তাকে একথা জানিয়ে দেয়া যে, সে যদি তার এ মর্যাদা ও
অবস্থানকে সঠিকভাবে উপলদ্ধি করে শোকর বা কৃতজ্ঞতামূলক আচরণ করে তাহলে তার
পরিণতি কি হবে এবং তা না করে যদি কুফরীর পথ অবলম্বন করে তাহলেই বা কি ধরনের
পরিণতির সম্মুখীন হবে। কুরআনের বড় বড় সূরাগুলোতে একটি বিশেষ বর্ণনাভঙ্গী
হলো পরবর্তী সময়ে যেসব বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে এ যুগে সে
বিষয়গুলোই অতি সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী পন্থায়
মন-মগজে গেঁথে দেয়া হয়েছে। এজন্য সুন্দর ও ছোট ছোট এমন বাক্য ব্যবহার করা
হয়েছে যা আপনা আপনি শ্রোতার মুখস্ত হয়ে যায়।
এতে সর্বপ্রথম মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এক সময় এমন ছিল, যখন সে
কিছুই ছিল না। তারপর সংমিশ্রিত বীর্য দ্বারা এত সূক্ষ্মভাবে তার সৃষ্টির
সূচনা করা হয়েছে যে, তার মা পর্যন্তও বুঝতে পারেনি যে, তার অস্তিত্বের
সূচনা হয়েছে। অন্য কেউও তার এ অনুবীক্ষণিক সত্তা দেখে একথা বলতে সক্ষম ছিল
না যে, এটাও আবার কোন মানুষ, যে পরবর্তী সময়ে এ পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা
হিসেবে গণ্য হবে। এরপর মানুষকে এ বলে সাবধান করা হয়েছে যে, এভাবে তোমাকে
সৃষ্টি করে এ পর্যায়ে তোমাকে পৌঁছানোর কারণ হলো তোমাকে দুনিয়াতে রেখে
আমি পরীক্ষা করতে চাই। তাই অন্যান্য সৃষ্টির সম্পূর্ণ বিপরীতে তোমাকে
বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছি এবং তোমার সামনে শোকর ও কুফরের
দু’টি পথ স্পষ্ট করে রেখে দেয়া হয়েছে। এখানে কাজ করার জন্য তোমাকে কিছু
সময়ও দেয়া হয়েছে। এখন আমি দেখতে চাই এ সময়ের মধ্যে কাজ করে অর্থাৎ এভাবে
গৃহীত পরীক্ষার মাধ্যমে তুমি নিজেকে শোকরগোজার বান্দা হিসেবে প্রমাণ করো
না কাফের বান্দা হিসেবে প্রমাণ করো।
অতপর যারা এ পরীক্ষায় কাফের বলে প্রমাণিত হবে আখেরাতে তাদের কি ধরনের
পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে তা শুধু একটি আয়াতের মাধ্যমেই পরিষ্কার ভাষায় বলে
দেয়া হয়েছে।
তারপর আয়াত নং ৫ থেকে ২২ পর্যন্ত একাদিক্রমে সেসব পুরস্কার ও প্রতিদানের
কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা দিয়ে সেসব লোকদের তাদের রবের কাছে
অভিষিক্ত করা হবে, যারা এখানে যথাযথভাবে বন্দেগী করেছে। এ আয়াতগুলোতে
শুধুমাত্র তাদের সর্বোত্তম প্রতিদান দেয়ার কথা বর্ণনা করাকেই যথেষ্ট মনে
করা হয়নি। বরং সংক্ষেপে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, কি কি কাজের জন্য তারা এ
প্রতিদান লাভ করবে। মক্কী যুগে অবতীর্ণ সূরাসমূহের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য
হলো, তাতে ইসলামের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার সংক্ষিপ্ত পরিচয়
দেয়ার সাথে সাথে কোন কোন ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিতে অতি মূল্যবান নৈতিক
গুণাবলী এবং নেক কাজের কথাও বর্ণনা করা হয়েছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এমন
সব কাজ-কর্ম ও এমন সব মন্দ নৈতিক দিকের উল্লেখ করা হয়েছে যা থেকে ইসলাম
মানুষকে পবিত্র করতে চায়। আর দুনিয়ার এ অস্থায়ী জীবনে ভাল অথবা মন্দ কি
ধরনের ফলাফল প্রকাশ পায় সেদিক বিবেচনা করে এ দু’টি জিনিস বর্ণনা করা হয়নি।
বরং আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনে তার স্থায়ী ফলাফল কি দাঁড়াবে কেবল সে দিকটি
বিবেচনা করেই তা বর্ণনা করা হয়েছে। দুনিয়ার এ জীবনে কোন খারাপ চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্য কল্যাণকর প্রমাণিত হোক বা কোন ভাল চারিত্রিক গুণ ক্ষতিকর
প্রমাণিত হোক তা এখানে বিবেচ্য নয়।
এ পর্যন্ত প্রথম রুকূ'র বিষয়বস্তু বর্ণনা করা হলো। এরপর দ্বিতীয় রুকূ'তে
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে তিনটি কথা বলা
হয়েছে। এক, এ কুরআনকে অল্প অল্প করে তোমার ওপরে আমিই নাযিল করছি। এর
উদ্দেশ্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাবধান করে দেয়া নয়, বরং
কাফেরদের সাবধান করে দেয়া। কাফেরদের সাবধান করা হয়েছে এই বলে যে, কুরআন
মজীদ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনগড়া বা স্বরচিত গ্রন্থ
নয়, বরং তার নাযিলকর্তা আমি নিজে। আমার জ্ঞান ও কর্মকৌশলের দাবি হলো, আমি
যেন তা একবারে নাযিল না করি বরং অল্প অল্প করে বারে বারে নাযিল করি।
দ্বিতীয় যে কথাটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে তাহলো,
তোমার রবের ফায়সালা আসতে যত দেরীই হোক না কেন এবং এ সময়ের মধ্যে তোমার
ওপর দিয়ে যত কঠিন ঝড়-ঝাঞ্চাই বয়ে যাক না কেন তুমি সর্বাবস্থায় ধৈর্যের সাথে
তোমার রিসালাতের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে থাকো। কখনো এসব
দুষ্কর্মশীল ও সত্য অস্বীকারকারী লোকদের কারো চাপে পড়ে নতি স্বীকার করবে
না। তৃতীয় যে কথাটি তাঁকে বলা হয়েছে তাহলো, রাত দিন সবসময় আল্লাহকে স্মরণ
করো, নামায পড় এবং আল্লাহর ইবাদাতে রাত কাটিয়ে দাও। কারণ কুফরের বিধ্বংসী
প্লাবনের মুখে এ জিনিসটিই আল্লাহর পথে আহবানকারীদের পা-কে দৃঢ় ও মজবুত করে।
এরপর আরেকটি ছোট বাক্যে কাফেরদের ভ্রান্ত আচরণের মূল কারণ বর্ণনা করে বলা
হয়েছে যে, তারা আখেরাতকে ভুলে দুনিয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়
আরেকটি বাক্যে তাদের এ মর্মে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা নিজে নিজেই
জন্ম লাভ করোনি। আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, বুকের এ চওড়া ছাতি এবং মজবুত ও
সবল হাত-পা তুমি নিজেই নিজের জন্য বানিয়ে নাও নি। ওগুলোও আমিই তৈরী
করেছি। আমি তোমাদের যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। সব সময়ের জন্য সে ক্ষমতা আমার
করায়ত্ব। আমি তোমাদের চেহারা ও আকৃতি বিকৃত করে দিতে পারি। তোমাদের
ধ্বংস করে অন্য কোন জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারি। তোমাদের
মেরে ফেলার পর যে চেহারা ও আকৃতিতে ইচ্ছা পুনরায় তোমাদের সৃষ্টি করতে
পারি।
সবশেষে এ বলে বক্তব্য শেষ করা হয়েছে যে, এ কুরআন একটি উপদেশপূর্ণ বাণী। যার
ইচ্ছা সে গ্রহণ করে তার প্রভুর পথ অবলম্বন করতে পারে। তবে দুনিয়াতে
মানুষের ইচ্ছা সব কিছু নয়। আল্লাহর ইচ্ছা না হওয়া পর্যন্ত কারো ইচ্ছাই
পূরণ হতে পারে না। তবে আল্লাহর ইচ্ছা অযৌক্তিকভাবে হয় না। তিনি যা-ই ইচ্ছা
করুন না কেন তা হয় নিজের জ্ঞান ও কর্মকৌশলের আলোকে। এ জ্ঞান ও কর্মকৌশলের
ভিত্তিতে তিনি যাকে তাঁর রহমত লাভের উপযুক্ত মনে করেন তাকে নিজের রহমতের
অন্তর্ভুক্ত করে নেন। আর তাঁর কাছে যে জালেম বলে প্রমাণিত হয় তার জন্য তিনি
অত্যন্ত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন