রবিবার, ১ মার্চ, ২০১৫

আল মুরসালাত-77

আল মুরসালাত-77
 
১.) শপথ সে (বাতাসের) যা একের পর এক প্রেরিত হয়।
 
২.) তারপর ঝড়ের গতিতে প্রবাহিত হয়
 
৩.) এবং (মেঘমালাকে) বহন করে নিয়ে ছড়িয়ে দেয়।
 
৪.) তারপর তাকে ফেঁড়ে বিচ্ছিন্ন করে।
 
৫.) অতঃপর (মনে আল্লাহর) স্মরণ জাগিয়ে দেয়,
 
৬.) ওজর হিসেবে অথবা ভীতি হিসেবে।
 
৭.) যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হচ্ছে তা অবশ্যই সংঘটিত হবে।
 
৮.) অতঃপর তারকাসমূহ যখন নিষ্প্রভ হয়ে যাবে
 
৯.) এবং আসমান ফেঁড়ে দেয়া হবে
 
১০.) আর পাহাড় ধুনিত করা হবে
 
১১.) এবং রসূলের হাজির হওয়ার সময় এসে পড়বে।
 
১২.) (সেদিন ঐ ঘটনাটি সংঘটিত হবে) । কোন দিনের জন্য একাজ বিলম্বিত করা হয়েছে?
 
১৩.) ফায়সালার দিনের জন্য।
 
১৪.) তুমি কি জান সে ফায়সালার দিনটি কি?
 
১৫.) সেদিন ধ্বংস অপেক্ষা করছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
 
১৬.) আমি কি পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করিনি?
 
১৭.) আবার পরবর্তী লোকদের তাদের অনুগামী করে দেব।
 
১৮.) অপরাধীদের সাথে আমরা এরূপই করে থাকি।
 
১৯.) সেদিন ধ্বংস অপেক্ষা করছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য। ১০
 
২০.) আমি কি তোমাদেরকে এক নগণ্য পানি থেকে সৃষ্টি করিনি
 
২১.) এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য১১
 
২২.) একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তা স্থাপন করেছিলাম না? ১২
 
২৩.) তাহলে দেখো, আমি তা করতে পেরেছি। অতএব আমি অত্যন্ত নিপুণ ক্ষমতাধর।১৩
 
২৪.) সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।১৪
 
২৫.) আমি কি যমীনকে ধারণ ক্ষমতার অধিকারী বানাইনি,
 
২৬.) জীবিত ও মৃত উভয়ের জন্য?
 
২৭.) আর আমি তাতে স্থাপন করেছি সুদৃঢ় উচ্চ পর্বতমালা আর পান করিয়েছি তোমাদেরকে সুপেয় পানি।১৫
 
২৮.) সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য। ১৬
 
২৯.) চলো১৭ এখন সে জিনিসের কাছে যাকে তোমরা মিথ্যা বলে মনে করতে।
 
৩০.) চলো সে ছায়ার কাছে যার আছে তিনটি শাখা। ১৮
 
৩১.) যে ছায়া ঠাণ্ডা নয় আবার আগুনের শিখা থেকে রক্ষাও করে না।
 
৩২.) সে আগুন প্রাসাদের মত বড় বড় ষ্ফূলিঙ্গ নিক্ষেপ করবে।
 
৩৩.) (উৎক্ষেপণের সময় যা দেখে মনে হবে) তবে যেন হলুদ বর্ণের উট। ১৯
 
৩৪.) সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
 
৩৫.) এটি সেদিন যেদিন তারা না কিছু বলবে
 
৩৬.) এবং না তাদেরকে ওজর পেশ করার সুযোগ দেয়া হবে।২০
 
৩৭.) সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
 
৩৮.) এটা চূড়ান্ত ফায়সালার দিন। আমি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের একত্রিত করেছি।
 
৩৯.) তোমাদের যদি কোন অপকৌশল থেকে থাকে তাহলে আমার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে দেখো২১
 
৪০.) সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
 
৪১.) মুত্তাকীরা২২ আজ সুশীলত ছায়া ও ঝর্ণাধারার মধ্যে অবস্থান করছে।
 
৪২.) আর যে ফল তারা কামনা করে (তা তাদের জন্য প্রস্তুত) ।
 
৪৩.) যে কাজ তোমরা করে এসেছো তার পুরস্কার স্বরূপ আজ তোমরা মজা করে খাও এবং পান করো।
 
৪৪.) আমি নেককার লোকদের এরূপ পুরস্কারই দিয়ে থাকি।
 
৪৫.) সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য। ২৩
 
৪৬.) খেয়ে নাও ২৪ এবং ফূর্তি কর। কিছুদিনের জন্য ২৫ আসলে তো তোমরা অপরাধী।
 
৪৭.) সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
 
৪৮.) যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহর সামনে অবনত হও, তখন তারা অবনত হয় না।২৬
 
৪৯.) সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
 
৪৯.) এখন এ কুরআন ছাড়া আর কোন বাণী এমন হতে পারে যার ওপর এরা ঈমান আনবে? ২৭

নামকরণ

প্রথম আয়াতের وَالۡمُرۡسَلٰتِ عُرۡفًاۙ শব্দটিকেই এ সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।

নাযিল হওয়ার সময়-কাল

এ সূরার পুরো বিষয়বস্তু থেকে প্রকাশ পায় যে, এটি মক্কী যুগের প্রথম দিকে নাযিল হয়েছিল। এর আগের দু'টি সূরা আর্থাৎ সূরা কিয়ামাহ ও সূরা দাহর এবং পরের দু'টি সূরা অর্থাৎ সূরা আননাবা ও নাযি’আত যদি এর সাথে মিলিয়ে পড়া যায় তাহলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, এ সূরাগুলো সব একই যুগে অবতীর্ণ।আর এর বিষয়বস্তুও একই যা বিভিন্ন ভংগিতে উপস্থাপন করে মক্কাবাসীদের মন-মগজে বদ্ধমূল করা হয়েছে।

বিষয়বস্তু ও মূলবক্তব্য

এর বিষয়বস্তু কিয়ামত ও আখেরাতকে প্রমাণ করা এবং এ সত্যকে অস্বীকার করলে কিংবা মেনে নিলে পরিণামের যেসব ফলাফল প্রকাশ পাবে সে বিষয়ে মক্কাবাসীদের সচেতন করে দেয়া।
কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার যে খবর দিচ্ছেন তা যে অবশ্যই হবে প্রথম সাতটি আয়াত বাতাসের ব্যবস্থাপনাকে তার সত্যতা ও বাস্তবতার সপক্ষে সাক্ষ্যী হিসেবে পেশ করা হয়েছে। এতে প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যে, যে অসীম ক্ষমতশালী সত্তা পৃথিবীতে এ বিস্ময়কর ব্যবস্থাপনা কায়েম করেছেন তাঁর শক্তি কিয়ামত সংঘটিত করতে অক্ষম হতে পারে না। আর যে স্পষ্ট যুক্তি ও কৌশল এ ব্যবস্থাপনার পেছনে কাজ করছে তাও প্রমাণ করে যে, আখেরাত অবশ্যই সংঘটিত হওয়া উচিত। কারণ পরম কুশলী স্রষ্টার কোন কাজই নিরর্থক ও উদ্দেশ্যহীন হতে পারে না। আখেরাত যদি না থাকে তাহলে এর অর্থ হলো, এ গোটা বিশ্ব-জাহান একেবারেই উদ্দেশ্যহীন।
মক্কাবাসীরা বারবার বলতো যে, তুমি আমাদের যে কিয়ামতের ভয় দেখাচ্ছো তা এনে দেখাও। তাহলে আমরা তা মেনে নেব। ৮ থেকে ১৫ আয়াতে তাদের এ দাবীর উল্লেখ না করে এ বলে তার জবাব দেয়া হয়েছে যে, তা কোন খেলা বা তামাশার বস্তু নয় যে, যখনই কোন ঠাট্টাবাজ বা ভাঁড় তা দেখানোর দাবী করবে তখনই তা দেখিয়ে দেয়া হবে। সেটা তো মানব জাতি ও তার প্রতিটি সদস্যের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়সালার দিন। সে জন্য আল্লাহ তা'আলা একটি বিশেষ সময় ঠিক করে রেখেছেন। ঠিক সে সময়ই তা সংঘটিত হবে। আর যখন তা আসবে তখন এমন ভয়ানক রূপ নিয়ে আসবে যে, আজ যারা ঠাট্টা-বিদ্রুপের ভংগিতে তার দাবী করছে সে সময় তারা দিশেহারা ও অস্থির হয়ে পড়বে।তখন ঐসব রসূলগণের সাক্ষ্য অনুসারেই এদের মোকদ্দমার ফায়সালা হবে, যাদের দেয়া খবরকে এসব আল্লাহদ্রোহী আজ অত্যন্ত নিঃশঙ্কচিত্তে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিচ্ছে।অতপর তারা নিজেরাই জানতে পারবে যে, কিভাবে তারা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের আয়োজন করেছে।
১৬ থেকে ১৮ আয়াত পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে কিয়ামত ও আখেরাত সংঘটিত হওয়া এবং তার অনিবার্যতার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। এসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষের নিজের ইতিহাস, তার জন্ম এবং যে পৃথিবীতে সে জীবন যাপন করেছে তার গঠন, আকৃতি ও বিন্যাস, সাক্ষ্য পেশ করছে যে, কিয়ামতের আসা এবং আখেরাত অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব এবং আল্লাহ তা'আলার প্রাজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার দাবীও বটে। মানুষের ইতিহাস বলছে, যেসব জাতিই আখেরাত অস্বীকার করেছে পরিণামে তারা বিপথগামী হয়েছে এবং ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এর অর্থ হলো, আখেরাত এমন একটি সত্য যে, যে জাতিরই আচার-আচরণ ও রীতি-নীতি এর বিপরীত হবে তার পরিণাম হবে সেই অন্ধের মত যে সামনেরর দিক থেকে দ্রুত এগিয়ে আসা গাড়ীর দিকে বল্গাহারার মত এগিয়ে যাচ্ছে। এর আরো একটি অর্থ হলো, বিশ্ব-সম্রাজ্যের মধ্যে শুধু প্রাকৃতিক আইন (Physical Law, কার্যকর নয়, বরং একটি নৈতিক আইনও (Moral Law, এখানে কার্যকর রয়েছে। আর এ বিধান অনুসারে এ পৃথিবীতেও কাজের প্রতিদান দেয়ার সিলসিলা বা ধারা চালু আছে। কিন্তু দুনিয়ার এ জীবনে প্রতিদানের এ বিধান যেহেতু পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হতে পারছে না। তাই বিশ্ব-জাহানের নৈতিক বিধান অনিবার্যভাবেই দাবী করে যে, এমন একটি সময় আসা উচিত যখন তা পুরোপুরি বাস্তাবায়িত হবে এবং সেসব ভাল ও মন্দের যথোপযুক্ত প্রতিদান বা শাস্তি দেয়া হবে যা এখানে উপযুক্ত প্রতিদান বা পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল বা শাস্তি থেকে বেঁচে গিয়েছিল। এর জন্য মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন হওয়া অপরিহার্য। মানুষ দুনিয়ায় যেভাবে জন্মলাভ করে সে বিষয়ে যদি সে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে তার বিবেক-বুদ্ধি-অবশ্য যদি সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি থাকে- এ বিষয়টি অস্বীকার করতে পারে না যে, যে আল্লাহ নগণ্য বীর্য দ্বারা মানুষ সৃষ্টির সূচনা করে তাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষে রূপান্তরিত করেছেন যে পৃথিবীতে বাস করে মৃত্যুর পর তার শরীরের বিভিন্ন অংশ সেখান থেকে উধাও হয়ে যায় না। বরং তার দেহের এক একটি অণূ পরমাণু এ পৃথিবীতেই বিদ্যমান থাকে। পৃথিবীর এ মাটির ভাণ্ডার থেকেই সে সৃষ্টি হয়, বেড়ে উঠে ও লালিত-পালিত হয় এবং পুনরায় সে পৃথিবীর মাটির ভাণ্ডারেই গচ্ছিত হয়।যে আল্লাহ মাটির এ ভাণ্ডার থেকে প্রথমবার তাকে বের করেছিলেন তাতে মিশে যাওয়ার পর তিনি তাকে পুনরায় বের করে আনতে সক্ষম। তাঁর যুক্তি ও কৌশল সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে তোমরা এ বিষয়টিও অস্বীকার করতে পারবে না যে, পৃথিবীতে যে ক্ষমতা ও ইখতিয়ার তিনি তোমাদের দিয়েছেন তার সঠিক ও ভুল প্রয়োগের হিসাব-নিকাশ নেয়াও নিশ্চিনভাবেই তাঁর বিচক্ষণতা ও বিজ্ঞতার দাবী এবং বিনা হিসেবে ছেড়ে দেয়াও তার যুক্তি ও কৌশলের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এরপর ২৮থেকে ৪০ পর্যন্ত আয়াতে আখেরাত অস্বীকারকারীদের পরিণাম বর্ণনা করা হয়েছে। ৪১ থেকে ৪৫ আয়াত পর্যন্ত সেসব লোকের পরিণাম বর্ণনা করা হয়েছে, যারা আখেরাতের ওপর ঈমান এনে দুনিয়ায় থেকেই নিজেদের পরিণাম গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। তারা আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা, নৈতিক চরিত্র ও কাজ-কর্ম এবং নিজের জীবন ও কর্মের সমস্ত মন্দ দিক থেকে দূরে অবস্থান করেছে যা মানুষের দুনিয়ার আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করলেও পরিণামকে ধ্বংস করে।
সবশেষে যারা আখেরাতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর বন্দেগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে যত আমোদ-ফূর্তি করতে চাও, করে নাও। শেষ অবধি তোমাদের পরিণাম হবে অত্যন্ত ধ্বংসকর। বক্তব্যের সমাপ্তি টানা হয়েছে এই বলে যে, কুরআনের মাধ্যমেও যে ব্যক্তি হিদায়াত লাভ করতে পারে না তাকে দুনিয়ার কোন জিনিসই হিদায়াত দান করতে সক্ষম নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন